অ্যাডভোকেট এম রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য। ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন, সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি নাটোর-২ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০১ সালের ১লা অক্টোবর নির্বাচনে বিএনপি সরকার গঠন করে। সেই মন্ত্রিসভায় স্থান পেয়েছিলেন এম রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু। পাঁচ বছর সামলেছেন ভ‚মি মন্ত্রণালয়।
২০১৮ সালের একাদশ নির্বাচনে তিনি যেন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে না পারেন সেজন্য ষড়যন্ত্র করে আওয়ামী লীগ। যদিও হাইকোর্ট প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার পক্ষে রায় দেয় এবং নির্বাচন কমিশনকে মনোনয়নপত্র গ্রহণের নির্দেশ দেন। তারপরও তিনি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেননি। তাকে কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির সক্রিয় রাজনীতিবিদ এম রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু। আওয়ামী লীগের জুলুম-নির্যাতন সহ্য করেও কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে দলকে সুসংগঠিত করেছেন। তিনি বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যও ছিলেন। বর্তমানে তিনি বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য। রাজনীতিবিদ এম রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুর মুখোমুখি হয়েছিল বারনই। দেশ ও নাটোরের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং নাটোরের ভবিষ্যত পরিকল্পনা নিয়ে ১০ প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ এম রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু।
বারনই: দীর্ঘ ১৬ বছর পর বিনা বাধায় রাজনীতি করছেন, সভা-সমাবেশ করছেন। গণঅভ্যুত্থানের পর নাটোরের রাজনীতি নিয়ে প্রথমে আপনার প্রতিক্রিয়া জানতে চাই।
এম রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু : আপনারা জানেন যে, বাংলাদেশের প্রতিটা জেলায় বিরোধী দলের ওপরে অন্যায়, নিপীড়ন, মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানিসহ নানা জুলুম করেছে অবৈধ আওয়ামী লীগ সরকার। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি নিপীড়ন করা হয়েছে নাটোর জেলায়। কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে নাটোরে কোন মিটিং, সমাবেশ, মিছিল করতে দেওয়া হয়নি। দলীয় লোকজনকে একত্রিত হতে দেখলেই চালানো হয়েছে হামলা। এমনকি ঘরের ভিতরে একটা মিলাদ মাহফিল করতে গেলেও তারা হামলা চালিয়েছে। এই ১৬ বছরে আমি নিজেও নাটোরে আমার নিজের বাড়িতে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করিনি।
শৈশব, কৈশোর ছাত্র জীবন, রাজনীতি জীবন, আমার উত্থান, আমার এমপি হওয়া, আমার মন্ত্রী হওয়া, আমার জীবনের দীর্ঘ সময় এই নাটোরে। আমার নাড়ি পোতা আছে এই নাটোরে। অথচ যে নাটোরে আমার সবকিছু সেই নাটোরে আমি রাতেও, আমার নিজের বাড়িতে ঘুমোতে নিরাপদ বোধ করিনি। নাটোরে এসে দীর্ঘ সময় নিশ্চিন্তে আমার বাড়িতে থাকবো সেই পরিবেশটা নাটোরে ছিল না। এতো প্রতিক‚লতার মাঝেও আমরা মনে করি এই ১৬ বছর পর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হয়েছে। এখন মনে হচ্ছে- এদেশের মানুষ যে স্বাধীনতার সুফল মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পেয়েছিল, ঠিক একই স্বাদ আমরা পেয়েছি, ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে।
আওয়ামী লীগ সরকারের, দুঃশাসন, স্বৈরশাসন, অত্যাচার, নিপীড়ন থেকে নতুনভাবে মুক্ত হয়েছে দেশ। ১৬ বছর দেশের মানুষ কথা বলতে পারেনি। মানুষের ভোটের অধিকার ছিল না। গণতন্ত্র ছিল না। সেখান থেকে মানুষ এখন স্বস্তি এবং স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে। সেজন্যে ভালো লাগছে। একটা সময় রিকশায় চড়ে, পায়ে হেঁটে নাটোর শহরের অলি-গলিতে চলাফেরা করেছি। বর্তমান প্রজন্মের ছেলেদের স্মরণে না থাকলেও, আঠারো বছর আগের কথা, নাটোরের অনেকেরই মনে আছে, আমি যখন মন্ত্রী ছিলাম, আমার পতাকাওয়ালা গাড়ি, আমার সিকিউরিটি, আগে পিছে পুলিশ, এই সমস্ত কিছু রেখে আমি পায়ে হেঁটে হেঁটে রিকশায় করে ঘুরতাম। সেই পরিবেশটা ১৬ বছর ছিল না। ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পরে এখন আমি আবার ভ্যান গাড়িতে, ইজিবাইকে, রিকশায় চড়ে, পায়ে হেঁটে, মুক্তভাবে চলাফেরা করছি। এই জীবনটাই আশা করেছিলাম। আমি আবার আগের জীবনে ফিরে এসেছি, মিটিং, মিছিল, সমাবেশ করছি। আলহামদুলিল্লাহ এটাই আমার অনেক বড় পাওয়া।
বারনই: আপনি নাটোরের যেখানে যাচ্ছেন, মানুষ সেখানেই ভিড় করছেন। আপনার এই জনপ্রিয়তার কারণ কি?
এম রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু : আমি বিএনপি দল করি এটা আমার গর্ব। আর বিএনপি করি বলেই আজকে আমি দুলু। বিএনপি করি বলেই আমি এমপি। বিএনপি করি বলেই আমি মন্ত্রী হয়েছিলাম। আর বিএনপি করি বলেই সারাদেশের মানুষ আমাকে চেনে। আমি জানিনা আমার কাছে জাদু আছে কিনা। আওয়ামী লীগ সরকার যখন ক্ষমতায় ছিল, তখনো আমি যেখানে গিয়েছি মানুষ আমাকে দেখার জন্য ছুটে আসতো। আমি যেখানেই গিয়েছি মানুষ সেখানে ভিড় করত। এখন যেমন আমার বাড়ির সামনে শত শত লোকের ভিড়, আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় ছিল তখনো আমার বাড়ির সামনে উপচেপড়া ভিড় হতো। তবে তখন একটা ভীতি কাজ করতো মানুষের মনে, তবুও আমি যে কয়েক ঘণ্টার জন্য নাটোরে আসতাম এই সময়টুকু মানুষের ভির থাকতো। মানুষের এই ভিড়, এই আকর্ষণ, এইটা সবসময়ই ছিল। এটা নতুন কিছু না। আমি মনে করি এটা আল্লাহ প্রদত্ত। সেজন্য আল্লাহর কাছে আমি কৃতজ্ঞ। শুধু এই নাটোর শহরেই না, আমার বাড়িতেই না, ঢাকায় আমি যেখানে থাকি সেখানেও গত ১৬ বছর হল আমি একটি অফিস মেইনটেইন করতাম। সাধারণ মানুষ ঢাকাতে আমার অফিসে দেখা করতো। আমি মানুষের জন্য কাজ করার চেষ্টা করি। যে অফিসেই হোক, যে জায়গায় হোক, আমি কথা বলি, মানুষ আমার প্রতি নির্ভর করে। বিশ্বাস করে যে আমার কাছে গেলে আমি কাউকে ফিরিয়ে দেবো না। মানুষের সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করি সে জন্যই মানুষ আমাকে খোঁজ করে, আমার কাছে আসে।
বারনই: আওয়ামী লীগের শাসনামলে আপনি নিজ বাড়িতে থাকতে পারেননি। ঈদের খাবার রেখে বাড়ি থেকে চলে যেতে হয়েছে। সেসময়ে দিনগুলোতে কিভাবে টিকে ছিলেন?
এম রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু : এই কথা যখন ভাবি, তখন আমার চোখে পানি চলে আসে। আমার খুব কান্না আসে। আমার বাড়ির সামনের দৃশ্যটা আপনারা দেখবেন। আমার বাড়িতে কিভাবে ভাঙচুর চালিয়েছে তা এখনো দৃশ্যমান। ফিলিস্তিনিতে ইসরাইলারা যেভাবে আক্রমণ করেছে, ঠিক নাটোরে একই অবস্থা করা হয়েছিলো। আমরা তাদের আক্রমণের শিকার হয়েছি। ওই দুর্বিষহ জীবনের কথা যখন মনে হয় আমার শরীর শিউরে ওঠে, ভাবতেই কষ্ট লাগে। আল্লাহ কাছে একটাই চাওয়া সেই দুর্বিষহ জীবন যেন ফেরত না আসে।
বিএনপি'র শাসনামলে আওয়ামী লীগের কোন মিটিং, মিছিল বা সমাবেশে আমরা কোনদিন বাধা দেইনি। তাদেরকে প্রতিহত করারও চেষ্টা করিনি। কিন্তু আওয়ামী লীগের শাসনামলে, আমাদের উপর যে জুলুম অন্যায় অবিচার করা হয়েছে, তার কোন প্রতিশোধ আমরা নিতে চাই না। কারণ আমরা প্রতিশোধপরায়ণ নই। আমাদের শাসনামলে যে সম্মান তাদেরকে করেছি, তাদের মধ্যে অনেকেই এখন মারা গিয়েছেন, অনেকেই বেঁচে আছেন। অ্যাডভোকেট সাজেদুর রহমান খান, মারা গেছেন, তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন, আমি জেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটির চেয়ারম্যান ছিলাম। তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে মিটিংয়ে যেতেন। উনি যতক্ষণ না চেয়ারে বসেছেন ততক্ষণ আমি চেয়ারে বসতাম না। সম্মান করেছি। এই একটা উদাহরণ দিয়ে বললাম। কিন্তু এই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরে তাদের লোকজন, যেভাবে আমাদের উপর অত্যাচার করেছে, আল্লাহ তাদের বিচার করেছেন। আমরা কখনোই তাদের যে আচরণ সে আচরণ করতে চাই না ইনশাআল্লাহ।
বারনই: আপনি যখন মন্ত্রী ছিলেন, নাটোরের উন্নয়নে অনেক কাজ করেছেন। ভবিষ্যতের নাটোর নিয়ে আপনার পরিকল্পনা কি?
এম রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু : আসলে নাটোর আমার স্বপ্ন। আমি রাজনীতি করি মানুষের জন্য। এ কথা বারবার প্রমাণিত হয়েছে নাটোরের মানুষের কাছে। দেশের মানুষের কাছে। আমি আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ। আমি নাটোরের জনগণের কাছে কৃতজ্ঞ। আমি মনে করি নাটোরের মানুষ সত্যিই আমাকে ভালোবাসে। নাটোরের মানুষ আমাকে বিশ্বাস করে। এই ১৮ বছরে আমার জনপ্রিয়তা আরো বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। হয়তোবা এই নতুন প্রজন্ম, নাটোরে যাদের ১৮ বছর আগে জন্ম হয়েছে, তারা আমাকে তেমনভাবে নাও চিনতে পারে। কারণ আমি তো নাটোর এসে থাকতে পারিনি। মানুষের দুয়ারে দুয়ারে যেতে পারিনি। এই কারণেই নতুন প্রজন্মের কাছে হয়তো বা আমি জনপ্রিয় হতে পারিনি। কিন্তু তারপরেও আমার নামে তারা আমাকে চেনে।
এই নাটোর সবচেয়ে বেশি অবহেলিত ছিল। আমি এমপি-মন্ত্রী হওয়ার পরে মানুষের যে মৌলিক চাহিদা ছিল, তা আমার সময়ে আমি পূরণ করতে সফল হয়েছিলাম। নাটোর শহরকে যানজট মুক্ত করতে নাটোরের হরিশপুর থেকে বনবেলঘড়িয়া পর্যন্ত তেবাড়িয়া হাটের মধ্য দিয়ে বাইপাস সড়ক নির্মাণ করেছিলাম। নাটোর শহর থেকে নলডাঙ্গা উপজেলার এমন কোন গ্রাম নেই, এমন কোন বাড়ি নেই, যেখানে পাকা রাস্তা নেই। গাড়িতে চড়েই বাড়িতে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছিলাম। আমি এমপি-মন্ত্রী হওয়ার আগে মানুষ বর্ষার সময় নৌকায় আর খরা মৌসুমে সময় পায়ে হেঁটে চলাফেরা করতে হতো। সামান্য একটু বৃষ্টি হলে কাদার কারণে তারা চলাফেরা করতে পারতো না। সেই সমস্ত প্রত্যন্ত অঞ্চলে বহু পাকা সড়ক নির্মাণ করেছিলাম। মিনি কক্সবাজার খ্যাত পাটুল থেকে খাজুরা মাধনগর যে সাবমারসিবল সড়ক আমার সময় পরিকল্পনা করে নির্মাণ করা হয়েছিল। আজকে বৃষ্টি বলেন, ঝড় বলেন, খারা বলেন, যা কিছু বলেন না কেন, রাত বারোটা বলেন, রাত ২টা বলেন ৩টা বলেন, ২৪ ঘণ্টা মানুষ চলাফেরা করতে পারে। অর্থাৎ মানুষের সাথে গ্রামের শহরের যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপন করা হয়েছিল বিএনপি সরকারের শাসনামলে। বিদ্যুৎ মানুষের জীবনের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় জিনিস। নাটোরের প্রতিটা ঘরে ঘরে, প্রতিটা বাড়িতে বাড়িতে, আমি যতদিন ক্ষমতায় ছিলাম বিদ্যুতের ব্যবস্থা করেছি। নাটোর শহর সন্ত্রাস মুক্ত একটি শহর, একটা শান্তির শহর নির্মাণ করতে চেয়েছিলাম এবং সেই পরিকল্পনা নিয়েই এগিয়ে চলছিলাম।
নাটোরকে দেশের মানুষ চিনতো না। আমি বিয়ের পরে পরিবার নিয়ে কক্সবাজার বেড়াতে গিয়েছিলাম। আমি যখন হোটেলে উঠলাম হোটেল কর্তৃপক্ষ বলেছিল আপনাদের বাড়ি কোথায়? আমরা যখন বলেছিলাম নাটোর। তখন নাটোর নামে বাংলাদেশের একটা জেলা আছে এটাই তারা জানে না। তখন আমি আহত হয়েছিলাম। সেদিন থেকেই স্বপ্ন ছিল এই নাটোরটাকে আমি বাংলাদেশের মানচিত্রে, পৃথিবীর মানচিত্রে, একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর হিসেবে তৈরি করব। সেই স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। আমি এইটুকু আপনাদেরকে আশ্বস্ত করতে চাই। আগামী দিনে আল্লাহ যদি আমাকে তৌফিক দেন, দত্তপাড়া থেকে দিঘাপতিয়া একটি বাইপাস সড়ক নির্মাণ করা হবে এবং দত্তপাড়া থেকে একডলা পর্যন্ত একটি বাইপাস সড়ক নির্মাণ করা হবে। নাটোরের হালতিবিল, চলনবিল, দিঘাপতিয়া রাজবাড়ী, রানী ভবানীর রাজবাডী, ধড়াইল জমিদার বাড়িসহ অনেক পর্যটন এলাকা রয়েছে যে সমস্ত এলাকায় মানুষ এলে থাকার বা খাবার ভালো কোন হোটেল বা মোটেল নেই। সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন একটি জেলা নাটোরবাসীকে উপহার দেওয়ার জন্য এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার ইচ্ছা আমার আছে ইনশাআল্লাহ। আগামী দিনে আল্লাহ যদি আমাকে সুযোগ দেয় নাটোরকে বাংলাদেশের মধ্যে একটি সুন্দর ব্যতিক্রমধর্মী, উন্নত ও শান্তির শহরে পরিণত করব ইনশাআল্লাহ।
বারনই: নাটোরের উপর দিয়ে গ্যাস লাইন গেছে অথচ নাটোরবাসী গ্যাস পায়নি। স্থানীয়রা আন্দোলন করলেও আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা গ্যাস সংযোগের প্রতিশ্ররুতি দিয়ে সেই আন্দোলন বানচাল করেছিল। অথচ এক যুগেও নাটোরবাসী গ্যাস পায়নি। বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখছেন?
এম রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু : আপনারা জানেন যে, প্রাণ কোম্পানির মালিক জেনারেল আমজাদ সাহেব আমার অত্যন্ত প্রিয় শ্রদ্ধেয় মানুষ। উনি যখন পরিকল্পনা করেছিলেন একটি ফ্যাক্টরি করবেন। আমি তখন নাটোরের এমপি, আমি তাকে গিয়ে অনেক অনুরোধ করেছিলাম ফ্যাক্টরিটা যেন নাটোরে করেন। আমার কথা তিনি রেখেছিলেন। বর্তমানে যেখানে কারখানা সেখানকার জমি ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা বিঘায় কিনে দিয়ে এই ফ্যাক্টরি কাজ শুরু করার জন্য, সেই সময় আমি সহযোগিতা করেছিলাম। এই প্রাণ কোম্পানি আমরা উদ্বোধন করি। সে সময় হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান করা হয়েছে।
আমি ওয়াদা করেছিলাম গ্যাস নাটোরে নিয়ে আসবো। কিন্তু পরবর্তীতে আপনারা জানেন যে আমরা ক্ষমতার বাইরে যাওয়ার কারণে আমার জায়গায় অন্য কেউ এমপি-মন্ত্রী হয়ে তাদের নিজেদের ভাগ্যের পরিবর্তন করেছে। চাঁদাবাজি করা হয়েছে নাটোরের এই প্রাণ, কিষোয়ান, পারটেক্স গ্রæপের মালিকের কাছ থেকে। তাদেরকে অত্যাচার, নির্যাতনসহ চাঁদাবাজি করেছে আওয়ামী লীগ। যে কারণে ভয়ে নাটোর থেকে তারা কারখানায় উঠিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল।
বিএনপি সরকার যদি ক্ষমতায় থাকতো আমি যদি এমপি থাকতাম তাহলে কোনদিনই নাটোরের উপর দিয়ে এই গ্যাস রাজশাহীতে যেতে দিতাম না। দরকার হলে গ্যাসের লাইন আমি কেটে দিতাম। আমার কথা হতো একটাই, এই গ্যাস যদি নাটোরের উপর দিয়ে রাজশাহীতে যায় তাহলে নাটোরে গ্যাস দিতে হবে। আমি ওয়াদা করছি আল্লাহ যদি আগামীতে আমাদেরকে, আগামী দিনে ক্ষমতায় নিয়ে আসার সুযোগ করে দেন, অবশ্যই ক্ষমতায় আসার এক মাসের মধ্যে আমি নাটোরবাসীর জন্য গ্যাসের ব্যবস্থা করে দিব।
বারনই: নাটোরের নারদ নদ এখন মৃত। আওয়ামী লীগের সময়ে খননের নামে প্রচুর অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। কিন্তু নারদ নদ খনন করা হয়নি। নারদ নদকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনেত কোনো উদ্যোগ কি আপনি নেবেন?
এম রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু : নারদ নদটা অনেক পুরাতন, আমি আগেই বলেছি, নাটোর নিয়ে আমার অনেক স্বপ্ন আছে। সেই স্বপ্নেরই অংশ নারদ নদ পুনরুদ্ধার। যারা নারদ নদের সংস্কার নিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ লোপাট করেছে, পলিটিক্যালি আমি তাদের বিরুদ্ধে কিছু বলতে চাই না। আইনি প্রক্রিয়ায় এই লুটপাটের বিচার হবে ইনশাল্লাহ। যারা পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে টাকা লুটপাট করেছে, শুধু পানি উন্নয়ন বোর্ডই না সব জায়গায় তো লুটপাট চলেছে। এসব বিষয়ে কষ্ট লাগে আপনাদেরকে বলতে খারাপ লাগে যে, শহরের ফুটপাতের হকারদের কাছে থেকে তারা চাঁদাবাদি করেছে, সিএনজি, অটোরিকশা, নিম্ন আয়ের মানুষও রেহাই পায়নি। নাটোরের প্রায় সকল শ্রেণীর মানুষেরই চাঁদা দিতে হয়েছে আওয়ামী লীগকে। এমন কোন জায়গা নেই, এমন কোন সেক্টর নেই, যেখান থেকে আওয়ামী লীগ নেতারা চাঁদা না তুলেছে। আওয়ামী লীগ নেতাদের সংসার চলতো, চাঁদা আর সরকারি অর্থ লুট করা টাকায়। আমি বিস্মিত একটা মানুষের সংসার চালতে কত টাকার প্রয়োজন হয়? ওদের কত টাকার দরকার? আমার ভাবতেও অবাক লাগে একটা মানুষের জীবনে কয় টাকা লাগে? এই টাকা তো আমি কবরে নিয়ে যেতে পারবো না। এই পৃথিবীতে আমি একাই এসেছিলাম আমাকে একাই চলে যেতে হবে। এই সমস্ত চাঁদাবাজি লুটতরাজের কথা যখন শুনি তখন আমি খুব আহত হই। সব জায়গায় তো লুটপাট শুধু যে নারদ সংস্কারের জন্য লুটপাট হয়েছে এমন তো নয়।
আমার পরিকল্পনা রয়েছে নারদ নদ সংস্কার করে পানির প্রবাহ ফিরিয়ে আনাসহ নারদ নদের দুইপাশে ওয়াকওয়ে নির্মাণ করা। যাতে করে মানুষ বিনোদনের জন্য ওয়াকওয়ে দিয়ে হাঁটা চলাফেরা করতে পারে। পর্যটক আকর্ষণ করতে কৃত্রিম নৌকা ভ্রমণের ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন পরিকল্পনা রয়েছে। মানুষ ভ্রমণের জন্য কক্সবাজার যায়, খাগড়াছড়ি বান্দরবান যায় তেমনিভাবে নাটোরের নারদ নদ সংস্কার হলে মানুষ নাটোর ভ্রমণে আসবে। এই নাটোর দেখার জন্য সারাদেশ তথা বিভিন্ন দেশ থেকে যাতে মানুষ আসে তেমনি একটি পর্যটন নগরী গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে। পরিকল্পিত স্বপ্নের নাটোর নির্মাণে অংশ হিসেবে নারদ নদ সংস্কার, সেই সাথে উত্তরা গণভবন, নাটোর রাজবাড়ী, ধরাইল জমিদার বাড়ি সংস্কারের ব্যবস্থা ইনশাল্লাহ আমরা করব।
বারনই: নাটোরের বিটিভি উপকেন্দ্র নিয়ে আপনার ভবিষ্যত পরিকল্পনা কি রয়েছে?
এম রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু : বর্তমান আধুনিক যুগ, যেখানে এনালকের কোন স্থান নেই। বিটিভি খুব বেশি মানুষ এখন দেখেনা। নতুন নতুন টেলিভিশন চ্যানেল আসছে। মানুষের টেলিভিশন দেখার তেমন একটা সময় নেই। মানুষ সবকিছু এখন দেখছে মোবাইল ফোনে। নাটোরের বিটিভি উপকেন্দ্রটি চট্টগ্রামের মতো পূর্ণাঙ্গ উপকেন্দ্র করে, আধুনিকায়ন করার পরিকল্পনা রয়েছে। যাতে করে নাটোরের শিল্পী সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও সাহিত্যিকরা সুন্দর সুন্দর অনুষ্ঠান তৈরি করতে পারে, সেই লক্ষ্যে কাজ করার ইচ্ছা আছে।
বারনই: নাটোর শহরে শিশু পার্ক নেই। লালবাজারের বাহাদুর শাহ্ পার্ক নষ্ট করে আওয়ামী লীগের দুই মেয়র মার্কেট বানিয়েছেন। গোপনের নিজেদের মধ্যে সেই মার্কেটের দোকান ভাগা-ভাগি করে নিয়েছেন। খোলা জায়গা নষ্ট করে এভাবে মার্কেট বানিয়ে লুটপাটের বিষয়ে আপনার প্রতিক্রিয়া জানতে চাই।
এম রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু : বাহাদুর শাহ পার্কে এক সময় আমরা দিঘির ধারে গিয়ে ছাত্র জীবনে বসে থাকতাম। এখন বর্তমানে সেই পার্ক নষ্ট করে মার্কেট নির্মাণ করা হয়েছে, বিষয়টি আমি জানি। এ ধরনের মানুষকে কেন মেয়র বানানো হয়? এদের নিয়ে আমি কোন মন্তব্য করতে চাই না।
একসময় ছোট একটা শহর ছিল, মানুষ ছিল কম। কিছুদিন আগেও এই শহরের জনসংখ্যা ছিল ৫০ থেকে ৬০ হাজার। এখন এই শহরে জনসংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। শহরটাও বড় হচ্ছে, বড় হবে। তবে বাবা মা ছেলে মেয়েদেরকে নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর জন্য নাটোর শহরের মধ্যে তেমন কোন জায়গা নেই। এক সময় টাউন পার্ক ছিল, শহীদ বাবুল পার্ক হিসেবে চিনত সেখানেও তো মার্কেট হয়ে গেছে। নাটোরে শিশুদের বিনোদনের জন্য কোন জায়গা নেই। যেগুলো জায়গা আছে সবই ভরাট হয়ে কিংবা মার্কেট হয়ে যাচ্ছে। হারিয়ে গেছে বিনোদনের জায়গা। শিশুদের জন্য পার্ক আর মানুষের বিনোদনের স্থান নির্মাণ করতে প্রয়োজন পরিকল্পনা। এই ১৬ বছর যারা ক্ষমতায় ছিল তারা তো নিজেদের পকেট ভরতেই ব্যস্ত ছিল। আমি আশা করছি আল্লাহ যদি তৌফিক দেন, পুরো নাটোরকে নিয়ে আমার একটি পরিকল্পনা রয়েছে।
বারনই: গত ১৬ বছরের নাটোরে রাস্তা-ভবন নির্মাণের নামে অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সেই সব দুর্নীতের শ্বেতপত্র প্রকাশের কোনো উদ্যোগ নেবেন?
এম রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু : এইটা একটা ভালো কথা বলেছেন। মনে করিয়ে দিয়েছেন। অবশ্যই যারা দীর্ঘদিন যাবত নাটোরে লুটপাট করেছে, নাটোরকে ধ্বংস করে দিয়েছে, এদের চরিত্র উন্মোচন না করলে, দেশের মানুষের কাছে, নাটোরের মানুষের কাছে দায়ী হয়ে থাকবো। তাই খুব তাড়াতাড়ি আওয়ামী সরকারের দোসরদের লুটপাটের শ্বেতপত্র প্রকাশ করা হবে। প্রয়োজনে আলাদা করে একটি কমিটি গঠন করা হবে। একটি ছোট কমিটির মাধ্যমে যাচাই বাছাই করে, যারা দেশের টাকা লুটপাট করেছে তাদের একটি শ্বেতপত্র অচিরেই প্রকাশ করব ইনশাআল্লাহ।
বারনই: আওয়ামী লীগের সময়ে আপনি প্রতিহিংসার রাজনীতির শিকার হয়েছেন। এখন নাটোরের আওয়ামী লীগের নেতারা আত্মগোপনে বা পালিয়েছেন। তাদরে উদ্দেশ্যে আপনি কিছু বলতে চান?
এম রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু : এর আগে যখন আমি এমপি ছিলাম। বিরোধীদলে ছিলাম তখনও আগুন দিয়ে আমার বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে অনেক কিছু। আমাকে উদ্দেশ্যে করে গুলি করা হয়েছে। নির্যাতন করা হয়েছে। আমাদের উপর হামলা করা হয়েছে। কিন্তুওদেরকে কোনদিন মিছিল করতে দেইনি, সমাবেশ, মিটিং করতে বাধা দেইনি। কোন কর্মসূচিতে হামলা করেছি এমন কোন নজির নেই। অথচ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে আমাদের উপর ধারাবাহিক হামলা চালিয়েছে। যারা ১৬টি বছর আমাদের উপর নির্যাতন করেছে, নাটোর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক শহীদুল ইসলাম বাচ্চু সাহেবের উপর হামলা করেছে, জেলা বিএনপির সদস্য সচিব রহিম নেওয়াজের উপর হামলা করেছে, নাটোরে জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক দেওয়ান শাহীনের উপর হামলা করা হয়েছে। আমাদের পার্টির সদর থানার সেক্রেটারি আবুলের উপর হামলা করেছে, আসাদের উপর হামলা করেছে, ডালিমের উপর হামলা করেছে। বিএনপি নেতাকর্মীদেও উপর হামরা বিচার যদি না করে এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়ে চলে যাই, পরবর্তীতে আল্লাহতালার কাছে কি জবাব দেব?
আওয়ামী লীগের দোসরা যা করেছে আমরা তা করতে চাই না। তারা যে অন্যায় করেছে সেই অন্যায়ের বিচার তো আল্লাহ করেই দিয়েছেন। মহাবিচার। আর আমাদের বিচার, আইনের বিচার, জনতার আদালতের বিচার। নাটোরের আওয়ামী লীগের দোসরদেরকে যদি মাফ করি, তাহলে আমার দলের নেতাকর্মীরা মেনে নেবে না। আমার প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলবে। কারণ তারা তো পঙ্গু হয়ে গেছে, সবাই মৃত্যুর মুখোমুখি। তাদের অনেককে আমরা হারিয়েছি। সুজনকে হারিয়েছি, রাকিব রায়হান, রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শহিদুল ইসলাম আজও নিখোঁজ। আমি মনে করি প্রতিটা অন্যায়, প্রতিটা অত্যাচার প্রতিটা খুনের বিচার করতে হবে। আইনের আওতায় নিয়ে এসে তাদের বিচার করা হবে ইনশাআল্লাহ।
বারনই: আমাদের সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
এম রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু : আপনাদেরকেও ধন্যবাদ।