স্থানীয় সরকার: একটি সহজিয়া ভাবনা

মুক্তাদীর আহমদ মুক্তা | মতামত | ফোরপিলার্সবিডি.কম
প্রকাশিত:
স্থানীয় সরকার: একটি সহজিয়া ভাবনা

স্থানীয় সরকার: একটি সহজিয়া ভাবনা

মুক্তাদীর আহমদ মুক্তা

স্থানীয় সরকার নিয়ে বাংলাদেশে অনেক জ্ঞানগর্ভ আলোচনা ও বিশ্লেষণ দেখা যায়। অথচ দেশের সংবিধানে ‘স্থানীয় সরকার’ বলতে কোনো শব্দই নেই। বাংলাদেশের সংবিধানে স্থানীয় সরকার ধারণাকে ‘স্থানীয় শাসন’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। সংবিধানের চতুর্থ ভাগের তৃতীয় পরিচ্ছদে স্থানীয় শাসন শিরোনামে ৫৯ (১) ধারায় বলা হয়েছে ‘আইনানুযায়ী নির্বাচিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত প্রতিষ্ঠানসমূহের উপর প্রজাতন্ত্রের প্রত্যেক প্রশাসনিক এককাংশের স্থানীয় শাসনের ভার প্রদান করা’।

এখন কথা হচ্ছে প্রত্যেক প্রশাসনিক এককাংশ বলতে আমরা কি বুঝি। পাণ্ডিত্যপূর্ণ আলোচনায় না গিয়ে সরলভাবে যদি বলতে হয় আমাদের বিদ্যমান বিভাগীয় পর্যায়, জেলা পর্যায়, উপজেলা পর্যায়, ইউনিয়ন পর্যায় একেকটি প্রশাসনিক ইউনিট। একেকটি প্রশাসনিক একাংশ। বিদ্যমান ব্যবস্থায় এই প্রশাসনিক ইউনিটগুলোতে কি সংবিধান অনুযায়ী ‘নির্বাচিত ব্যক্তিদের’ কোনো কর্তৃত্ব তো দূরের কথা উপস্থিতি জানানোর সুযোগ রয়েছে।

আমাদের রাষ্ট্রের বিদ্যমান ব্যবস্থা অনুযায়ী স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে সিটি করপোরেশন, জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ।

প্রতিটি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের জন্য রয়েছে পৃথক আইন। এই আইনগুলো প্রতিষ্ঠানগুলোকে এমনভাবে পরিচালিত করছে যা প্রশাসনিক একাংশ তো দূরের কথা জনপ্রতিনিধিত্বশীলও হতে পারছে না। অন্তর্বর্তী অবস্থা বা সাময়িক বিচ্যুতি বাদ দিলে আমাদের দেশ চলে সংসদীয় ব্যবস্থায়। অথচ আমাদের স্থানীয় সরকারগুলো অনেককাংশে রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থার মতো।

আইনে সিটি করপোরেশনের মেয়রকে এতো একক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে নির্বাচিত কাউন্সিলরদের সেখানে ভূমিকা রাখার সুযোগ খুবই কম। একই অবস্থা পৌরসভা গুলোর ক্ষেত্রেও। দুটি প্রতিষ্ঠানেই  আছেন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা যিনি জাতীয় সরকারের একজন কর্মকর্তা।  বিধি বা প্রজ্ঞাপন দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অনেকটা তাদের তদারকিতেই রাখার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। জেলা পরিষদ ও উপজেলা পরিষদের অবস্থাতো আরো করুণ।  জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের ক্ষমতার কাছে নির্বাচিত সদস্যরা প্রায় অস্তিত্বহীন। এখানেও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার ক্ষমতা কোনো কোনো ক্ষেত্রে নির্বাচিত চেয়ারম্যানের চেয়েও বেশি।

উপজেলা পরিষদ সবচেয়ে অকার্যকর একটি প্রতিষ্ঠান। অথচ সবচেয়ে বেশি আইনি ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে উপজেলা পরিষদকে। উপজেলা পরিষদ দেশের একমাত্র স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান যাদের কাছে সরকারের বিভিন্ন বিভাগ হস্তান্তরিত করা হয়েছে। যেমন উপজেলা পর্যায়ে কর্মরত কৃষি বিভাগ , শিক্ষা বিভাগ , স্বাস্থ্য বিভাগ , মৎস্য বিভাগ, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগসহ মোট ১৭ টি দপ্তর উপজেলা পরিষদের কাছে হস্তান্তরিত। অথচ কার্যক্ষেত্রে হস্তান্তরিত বিভাগগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা মন্ত্রণালয় কর্তৃক জারিকৃত বিধি বা প্রজ্ঞাপন দ্বারা পরিষদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে। যেখানে আইনে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে উপজেলা পরিষদকে সাচিবিক সহায়তা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। সেখানে প্রকৃতপক্ষে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা উপজেলা পরিষদ তথা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করেছেন। এখানে স্ব শাসিত স্থানীয় সরকারের পরিবর্তে দ্বৈত শাসনের ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করে রাখা হয়েছে।

আমাদের সবচেয়ে প্রাচীন ও গতিশীল স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা হচ্ছে ইউনিয়ন পরিষদ। অথচ এই প্রতিষ্ঠানকে কৌশলে আইন বহির্ভূতভাবে পরিচালনা করা হচ্ছে। এখানেও নির্বাচিত চেয়ারম্যানের অনুগ্রহের কাছে বন্দী থাকতে হয় নির্বাচিত ইউ পি সদস্য, সদস্যাদের। সাম্প্রতিককালে ইউনিয়ন পরিষদ সচিব কে প্রশাসনিক কর্মকর্তা নাম দেওয়া হয়েছে। এখানেও আমলাতন্ত্রের অশুভ হস্তক্ষেপের ক্ষেত্র ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। গ্রামের সাধারণ মানুষের বিভিন্ন ভাতাসহ নানা নাগরিক সুবিধা প্রদানেও রাজনৈতিক বিবেচনা প্রাধান্য পাওয়ায় স্বকীয়তা ও মর্যাদা হারাচ্ছে জনগণের সবচেয়ে কাছের এই প্রতিষ্ঠানটি। এতে করে সমাজে তৈরি হচ্ছে মধ্যসত্ত্বভোগী একটি লুটেরা গোষ্ঠী। যার দায় সংশ্লিষ্টরা এড়াতে পারেন না।

আমাদের রাজনৈতিক দল বলেন বা নীতি নির্ধারণী মহল বলেন সকলেই স্থানীয় সরকার শক্তিশালী করার কথা বলেন। এরা তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করে কথা বললেও প্রায়োগিক অবস্থা বিবেচনায়ই নেন না। আইনে অনেক ক্ষমতা থাকার পরও কেন বিধি বা প্রজ্ঞাপন দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অকার্যকর করে রাখা হয় অনেকে সে খবরও জানেন না। 

দাতাগোষ্ঠীর সহায়তায় স্থানীয় সরকার শক্তিশালী করার জন্য বিভিন্ন প্রকল্প মন্ত্রণালয় গ্রহণ করে। কিন্তু এগুলো প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যকরে বা জনকল্যাণে কতটুকু ভূমিকা রাখে তার সঠিক মূল্যায়ন করা হয় না। পাইলট প্রকল্পের নামে দেশের বিভিন্ন জায়গায় কিছু প্রতিষ্ঠানকে কার্যকর ও সক্রিয় দেখানোর চেষ্টা থাকলেও দেশের বেশিরভাগ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো মুখ থুবড়ে পড়ে আছে।

সংবিধান ও আইনের কাঠামোতে জাতীয় সংসদ সদস্যদের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠাগুলোতে সংশ্লিষ্টতা না থাকার কথা থাকলেও, বাস্তবিক অর্থে স্থানীয় সংসদ সদস্যরাই হয়ে উঠেন স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর অধিকর্তা। প্রকল্প গ্রহণ থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের বিভিন্ন সহায়তা প্রাপ্তির তালিকাও এমপিদের অনুমতি নিয়ে করতে হয়। এটাই হয়ে গেছে অলিখিত রেওয়াজ। আর এখানে এমপির কর্তৃত্ব পাকাপোক্ত করতে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন সরকারি কর্মকর্তারা।

রাজনৈতিক দলের প্রতীক দিয়ে স্থানীয় সরকার নির্বাচন পদ্ধতি চালু করে স্থানীয় সরকারগুলোকে দলীয়করণ করা হয়েছে। যেখানে সাধারণ মানুষের সেবাপ্রাপ্তির চেয়ে দলীয় কর্মীদের সুযোগ সুবিধা নিশ্চিতের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা করা হয়েছে। এতে করে নষ্ট হয়েছে স্থানীয় সম্প্রীতির বন্ধন।

দেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর দেশে অন্তর্বতীকালীন সরকার দায়িত্ব পালন করছে। বিভিন্ন সংস্কার কমিশনের মতো স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনও করা হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক স্থানীয় সরকারে দায়িত্ব পালনকারী কোনো জনপ্রতিনিধিকে সংস্কার কমিশনে রাখা হয়নি। সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ হিসেবে অত্যন্ত যোগ্য লোক। কিন্তু সদস্যদের মধ্যে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার বিশেষজ্ঞদের পাশাপাশি মাঠ পর্যায়ে কাজ করা স্থানীয় সরকার জনপ্রতিনিধিদের এখানে কাজে লাগানো যেতে পারতো। স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা হিসেবে যিনি দায়িত্ব পালন করছেন স্থানীয় সরকার সম্পর্কে তার কতটুকু ধারণা রয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন তোলারও অবকাশ রয়েছে।

রাজনৈতিক কারণে  বা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বিরাগভাজন হয়ে বিভিন্ন সময় স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের বরখাস্ত করা হয়। অথচ স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। আইনের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের অপরাধের যাছাই ও শাস্তি প্রদান শোভনীয় হয়। এতে করে জনগণের কাছেও সরকার সম্পর্কে ভুল বার্তা যায় না। অথচ আমাদের আমলাতন্ত্র এগুলোর চর্চা বা বিচার বিশ্লেষণ না করে কর্তার ইচ্ছায় কর্ম করে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি অন্যায় ও অনেকাংশে অপরাধমূলক আচরণ করছেন।

বর্তমানে তো দেশে স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি বলতে কিছু নেই। সর্বত্র প্রশাসক ও সমন্বয়কদের কর্তৃত্ব ও খবরদারী। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ছাড়া দায়বদ্ধ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান পরিচালনা সম্ভবপর নয়। আমাদের নীতি নির্ধারকদের বাস্তবতা বুঝতে হবে। সত্যিই যদি দেশে কার্যকর স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হয়। তাহলে বিদ্যমান সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে কার্যকর সমাধানের পথ খুঁজে বের করতে হবে। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা সংসদীয় ব্যবস্থার আদলে চলবে, না রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থার আদলে চলবে তা আগে নির্ধারণ করতে হবে।

একেক প্রতিষ্ঠানের জন্য একেক আইন না করে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার জন্য কেন্দ্রীভূত একক আইনও করা যেতে পারে। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে সরকারি কর্মকর্তা নিয়োগের জন্য স্থানীয় সরকার সিভিল সার্ভিস নামে পৃথক ব্যবস্থা করা যেতে পারে। যারা শুধু স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠাগুলোতেই কাজ করবেন। এতে করে প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজের ধারাবাহিকতা রক্ষার পাশাপাশি স্থানীয় সরকারে সেবা দেওয়ার জন্য অভিজ্ঞ, আইনজ্ঞ কর্মকর্তা নিয়োজন নিশ্চিত হবে।

অধ্যাদেশের বলে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠাগুলোকে সাময়িক প্রাণসঞ্চার না করে নির্বাচিত জাতীয় সংসদে চুলচেরা বিশ্লেষন করে স্থানীয় সরকার কমিশন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। স্থানীয় সরকার কমিশনের মাধ্যমে স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের অসদাচরণ ও আইন বর্হিভূত কার্যক্রমের কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান রাখা প্রয়োজন।

আমাদের সমস্যা, আমরা যে যেখানে বসি। আমরা মনে করি আমিই সেরা। সচিবালয়ের কর্তারা আইন বা বিধি করে দেন। কিন্তু এইসব বিধি দেশের সকল অঞ্চলে সমানভাবে প্রযোজ্য কিনা বা বাস্তবায়নযোগ্য কিনা সেই ভাবনা তারা মাথায় রাখেন না। দেশের উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে তৃণমূল থেকে। অথচ আমাদের এখানে কেন্দ্রে পরিকল্পনা গ্রহণ করে প্রান্তে বাস্তবায়নের জন্য পাঠানো হয়। এতে করে যেখানে যা প্রয়োজন নয় সেখানে সে রকম প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়। আর প্রয়োজনীয় প্রকল্প থেকে অগ্রাধিকার যোগ্য এলাকা বাদ পড়ে। এসব ধারণা থেকে বের হয়ে তৃণমূলের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে সাধারণের ভাষা সরকারের ভাবনায় নেওয়া উচিত।

স্থানীয় সরকার মানে জনগণের কাছের সরকার। প্রকৃত অর্থে জনগণের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছাতে হলে স্বশাসিত, কার্যকর,গতিশীল স্থানীয় সরকারের বিকল্প নেই। এজন্য প্রয়োজনে স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের জন্য বিভিন্ন মানদণ্ড নির্ধারণ করা যেতে পারে। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই আইন প্রণেতারা যেন স্থানীয় সরকারের কার্যক্রমে বাঁধা হয়ে না দাঁড়ান তা নিশ্চিত করতে হবে। 

একসময় স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান সমূহে স্থানীয়ভাবে গ্রহণযোগ্য বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ অংশ নিতেন। মানুষ স্থানীয় আবেগ ও স্থানীয় প্রয়োজনীয়তা বিবেচনায় নিয়ে তার প্রতিনিধি নির্বাচিত করতেন। এখন মনোনয়ন বাণিজ্য, কালোটাকা ও পেশিশক্তির দাপটে নির্দলীয়, নিরপেক্ষ মানুষজন নির্বাচনের চিন্তাও মাথায় আনেন না।

যেখানে দেশে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার জন্য বিশ হাজার টাকা মনোনয়ন ফি নির্ধারন করা। সেখানে একজন উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের জন্য এক লক্ষ টাকা মনোনয়ন ফি নির্ধারণ করেছে নির্বাচন কমিশন। এরকম শত শত অসঙ্গতি, আইন বর্হিভূত কার্যক্রমের ব্যবস্থা রয়েছে আমাদের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো অকার্যকর রাখতে।  একটি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম আরেকটি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের  কার্যক্রমের সঙ্গে অনেক সময় সাংঘর্ষিক হয়ে দাঁড়ায়। একই প্রকল্প একাধিক প্রতিষ্ঠান গ্রহণ করে। এতে যেমন দুর্ণীতি হয় তেমনি  সম্পদেরও অপচয় হয়। এসবও কর্তাব্যক্তিদের ভাবনায় রাখা জরুরি।

সবশেষে বলবো স্থানীয় সরকারকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার জন্য আয়ের উৎস সৃষ্টির পথ জাতীয় সরকারকেই করে দিতে হবে। মাঠ পর্যায় থেকে বিভিন্ন খাতের অর্জিত রাজস্ব আয় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বিধি নির্ধারিত পদ্ধতিতে সরবরাহ করতে পারলে, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাবলম্ভী হবে। তখন নিজেরাও  নিজেদের আয় বৃদ্ধিতে উৎসাহী হবে। এর উপযুক্ততা, বাস্তবতা এবং বাস্তবায়নযোগ্য খাতও রয়েছে। শুধু প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের সদিচ্ছা, আন্তরিকতা, কর্মদক্ষতা ও জবাবদিহিতা। সর্বোপরি যোগ্য ও উপযুক্ত কর্ম পরিষদ নির্বাচিত করে নিয়ে আসার পরিবেশ নিশ্চিতের মানসিকতা।

মুক্তাদীর আহমদ মুক্তা,  সাবেক স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি, সাংবাদিক ও রাজনৈতিক কর্মী।

মতামত বিভাগের আরও খবর

আয়কর রিটার্ন ভুল হলে সমাধান আছে আইনেই

আয়কর রিটার্ন ভুল হলে সমাধান আছে আইনেই

মোহাম্মদ সিরাজ উদ্দিন

আয়কর রিটার্ন দাখিল করাকে অনেকে ঝামেলার কাজ মনে করেন। এই ঝামেলা মনে করার কারণ নানাবিধ। কেউ মনে করেন তিনি আয় করেন, সরকারকে ট্যাক্স দিয়ে দেন, এটাই যথেষ্ট, আবার রিটার্ন দেবেন কেন? এটা কেউ বুঝে বলেন কিনা তাও বোঝা যায় না, কেউ একেবারেই না বুঝে বলেন, কেউ বা বলেন ধারণা থেকে। এই বলাবলির শেষ হয়তো হবে না, কিন্তু তার বা তাহাদের বা নাগরিকদের শেষ পরিণতি হলো আয়, ব্যয় ও সম্পত্তির হিসাব এনবিআর-এ জমা দিতে হয়। কারণ রীতিতে আছে, দুনিয়ার অন্যান্য দেশে আছে, আমাদের দেশে আইনেও আছে। নাগরিক হিসেবে আইন না মানলে আর্থিক দণ্ড হওয়ার যেমন ভয় আছে, তেমনি জেলও খাটার ভয় আছে।

এসব দলিলি, বেদলিলি আলোচনা যখন বাজারে চলমান থাকে, এর মাঝে আরেক দল নাগরিককে হা-হুতাশ করতে থাকে, তার রিটার্ন ভুল হয়ে গেছে! এখন কী করবেন? কর অফিসে গেলেই বুঝি একঝাঁক বকা আর কেরানির ঘুতঘুতানি শুনতে হবে। কেউ বা মনে মনে ধরেই নিয়েছে অফিসে গেলেই কেউ একজন টেবিলের নিচ দিয়ে হাত দিয়ে বলবেন কিছু দিয়ে দেন ঠিক করে দেবেন, বা কেউ হেসে বলবে চা খাবার পয়সা দেন ঠিক করে দিচ্ছি। কেউ বলবেন, “আরে আল্লাহ! আপনি বিশাল ভুল করেছেন! আপনার বড় অঙ্কের জরিমানা হবে!” এসব হতাশা ও মুখরোচক বা অপ্রিয় কথাগুলো করদাতা শুনেন প্রতিনিয়ত, এমনটা একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

আচ্ছা ধরে নিলাম আপনি আয়কর রিটার্ন নিজে নিজে করেন। আপনি একজন করদাতা যখন নিজেই রিটার্ন দাখিল করার উদ্যোগ নেবেন, বা নিয়েছেন, এই জন্য আপনাকে এই অধমের পক্ষ থেকে প্রথমেই আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। কারণ আপনি একজন গর্বিত করদাতাই শুধু নয়, আপনি একজন সচেতন নাগরিকও বটে। অধিকতর সচেতন মানুষেরাই নিজের কাজ নিজে করেন। এই জন্যে আপনি নিজের আয়-ব্যয় ও সম্পত্তির হিসাব সরকারকে দিতে উদ্যোগ নিয়েছেন বা নিজেই দিয়ে থাকেন। হ্যাঁ, সবাই সমানভাবে পারবেন এমনটা কখনও চিন্তা করা ঠিক না। ভুল হতেই পারে। ভুল যেখানে, সমাধানও সেখানে আছে।

একজন দাতা সাধারণত নিজে নিজে ফাইল করতে গিয়ে যে ভুলগুলো করে থাকেন: একাধিক খাতের আয় থাকলে সব খাতের আয় যথাযথভাবে উপস্থাপন করেন না, সম্পত্তির হিসাব সঠিকভাবে লিখেন না, কোন সম্পত্তি ক্রয় বা বিক্রি থাকলে তা সঠিকভাবে উপস্থাপন করেন না, বিগত বছরের জের টানতে ভুল করেন, বিগত বছরের নিট সম্পত্তি চলতি বছরে লেখতে ভুল করেন, আর্থিক পরিসম্পদ থেকে আয়গুলো যথাসময়ে হিসাবভুক্ত করেন না, পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রি করার অর্থ প্রদর্শন করেন না, আগের জমি বা প্লট বা ফ্ল্যাট বিক্রির অর্থ যথাযথভাবে উপস্থাপন করেন না বা কোনও নিকট আত্মীয় থেকে প্রাপ্ত দান প্রদর্শন করতে ভুলে যান ইত্যাদি। কিন্তু রিটার্ন জমা দেওয়ার পর তার কাছে মনে হলো তিনি এই ভুলগুলোর মধ্যে কোনও না কোনও ভুল করেছেন।

রিটার্ন নিজের কাছে ধরার সাথেই যে কাজটি করবেন: আপনার জমা দেওয়া রিটার্ন পরবর্তীতে ভুল হয়েছে এমন মনে হলে একজন নিয়মিত কর-আইনজীবীর সহায়তা নিতে পারেন বা আপনার চেয়েও ভালো জানেন এমন কোনও একজন সহকর্মী, বন্ধু বা পরিচিতজনকে অনুরোধ করতে পারেন, আপনি যা ভুল মনে করছেন, তা ভুল কিনা। যদি সত্যিই ভুল হয়েই থাকে, তাহলে কোনও রকম ভয়-ডর ছাড়াই আপনি সংশোধনী রিটার্ন দাখিল করতে পারেন। এই সংশোধনী রিটার্ন যেকোনও সময় দাখিল করা যায়। তবে আইনে আছে ৬ মাসের মধ্যে কোনও দরখাস্ত করতে হবে না। এই সময়ের মধ্যে আপনি যখনই মনে করবেন আপনার রিটার্ন ভুল হয়েছে, তখনই সংশোধনী রিটার্ন জমা দিবেন। ছয় মাস অতিবাহিত হলে আপনার সার্কেলের উপ-কর কমিশনার বরাবর একটা দরখাস্ত করে আপনি স্ব-উদ্যোগে সংশোধনী রিটার্ন দাখিল করতে পারবেন। এই জন্যে অহেতুক কোনও চিন্তা করা থেকে বিরত থাকলেই যথেষ্ট।

সংশোধনী রিটার্ন সম্পর্কে আইনে যে সমাধান আছে: আয়কর আইন ২০২৩ এর ১৭৫ ধারা মোতাবেক “সাধারণ রিটার্ন”-এর ক্ষেত্রে সংশোধনী রিটার্ন দাখিল করা যাবে। (১) ধারা ১৬৬ বা ২১২ অনুসারে “সাধারণ রিটার্ন” দাখিলের পর রিটার্নে কোনও উপেক্ষিত বা অশুদ্ধ বিবৃতি পরিলক্ষিত হলে, কোনও প্রকার করদায় হ্রাস না করে, সংশোধনী রিটার্ন দাখিল করা যাবে। যে ক্ষেত্রে কর নির্ধারণ সম্পন্ন হয়নি, সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট করবর্ষের কর নির্ধারণী আদেশে প্রণয়নের সর্বশেষ তারিখের অন্তত ৬ (ছয়) মাস পূর্বে অথবা প্রথমবার ধার্যকৃত শুনানির তারিখের পূর্বে, যা আগে ঘটবে, সংশোধনী রিটার্ন দাখিল করতে হবে। (২) রিটার্ন বা সংশোধনী রিটার্নটি অসম্পূর্ণ বলা হলে, উপ-কর কমিশনার, কারণ উল্লেখপূর্বক, করদাতার নিকট সংশ্লিষ্ট তথ্যাদি যাচাইকরণ, বিবৃতি বা দলিলাদি নোটিশে উল্লেখিত সময়ের মধ্যে দাখিল করার জন্য নোটিশ প্রদান করবেন। (৩) কোনও করদাতা উপ-ধারা (২)-এর অধীনে প্রদত্ত নোটিশ সম্পূর্ণরূপে অনুসরণ করতে ব্যর্থ হলে, রিটার্ন বা সংশোধনী রিটার্ন যা অসম্পূর্ণ বলা হয়েছিল তা বাতিল বা অবৈধভাবে বিবেচিত হবে।

এছাড়া সংশোধিত রিটার্ন দাখিলের ক্ষেত্রে “আয়কর আইন ২০২৩-এর ধারা ১৮০-এর উপ-ধারা ২ দফা-গ অনুযায়ী যদি আইনের অধীন প্রদেয় কর সঠিকভাবে পরিগণিত না হয় বা সঠিক পরিশোধিত না হয়, তাহলে করদাতা একটি লিখিত বিবৃতিতে কারণ উল্লেখপূর্বক সংশোধিত রিটার্ন দাখিল করতে পারবেন।”

করদাতাগণকে সতর্ক থাকতে হবে যেন আয়কর রিটার্নে ইচ্ছাকৃত কোনও ভুল তথ্য বা অতিরিক্ত কাগজপত্রাদি সংযুক্ত করা না হয়। এতে সংশ্লিষ্ট কর-কর্মকর্তারা অহেতুক বিবর্তন হন এবং করদাতাকে ভুল বুঝতে পারেন। সরল বিশ্বাসে ভুল হলে সংশোধন করা যায়। কিন্তু ইচ্ছাকৃত কোনও তথ্য গোপন করা বা ভুল তথ্য উপস্থাপন কাম্য নয়, বরং এতে আইনি জটিলতা বৃদ্ধি পায়। আসুন আইন জানি, সতর্ক থাকি এবং আইনি সুরক্ষার সুযোগগুলো গ্রহণ করি।

মোহাম্মদ সিরাজ উদ্দিন: আইনজীবী, ঢাকা।

একটি পক্ষপাতহীন, দক্ষ বিশ্ব চাই নারীর জন্য

একটি পক্ষপাতহীন, দক্ষ বিশ্ব চাই নারীর জন্য

সুপ্রীতি ধর

জাতিসংঘের পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে ২০২২ সালের ঘোষণায় লিঙ্গবৈষম্যহীন একটি বিশ্ব কল্পনা করতে বলা হয়েছিল যেখানে থাকবে না কোন ধরনের পক্ষপাত, স্টেরিওটাইপ এবং বৈষম্য, বিশ্ব হবে বৈচিত্র্যময়, সমতাপূর্ণ এবং সবার সমান অন্তর্ভুক্তি যেখানে নিশ্চিত হবে, যে বিশ্বে ভিন্নতা, পার্থক্যকে মূল্যায়ন করা হবে, উদযাপন করা হবে। বলা হয়েছিল, রুখে দাও ‘পক্ষপাত’, সমতাপূর্ণ বিশ্বের এই হোক মূলমন্ত্র।

আবার ২০২৩ সালে বলা হয়েছে, জেন্ডার সমতার লক্ষ্যে উদ্ভাবন ও প্রযুক্তি। সারাবিশ্বে এই খাতে নারীর অংশগ্রহণ শতকরা মাত্র ২২ ভাগ বলেই নারীকে উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় শামিল করাই ছিল এই উদ্যোগের লক্ষ্য।

ঠিক এর পরের বছরই নারীর প্রতি বিনিয়োগ বাড়ানোর কথা বলা হলো যেন উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়।

মূলত প্রতিটি ঘোষণা এবং উদ্যোগই নারীর ক্ষমতায়ণ ও অগ্রগতি সাধনের লক্ষ্যে। কোন সন্দেহ নেই এতে। একসাথে মিলে আমরাই পারি নারীর জন্য সমতাপূর্ণ এমন একটি বিশ্ব তৈরি করতে। এবং সবাই মিলেই এই পক্ষপাতদুষ্ট সিস্টেমকে বদলে দিতে।

স্বতঃস্ফূর্ত হোক অথবা অসচেতনতার কারণেই হোক, পক্ষপাত যে কাউকে, বিশেষ করে নারীর সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথটাকে কঠিন করে তোলে, কখনও কখনও তা অতিক্রম করা অসম্ভব হয়ে উঠে নারীর জন্য, সেই প্রতিবন্ধকতাগুলোকে চিহ্নিত করে উপড়ে ফেলতে না পারলে আমরা মুখে যতোই নারীর অগ্রযাত্রা আর সাম্যের গান গাই না কেন, খুব বেশিদূর নারীর পক্ষে হাঁটা সম্ভব হয় না। সমাজে, রাষ্ট্রে বৈষম্য, পক্ষপাত আছে, এটা জানাও বড় কথা নয়, একটা লেভেল-প্লেয়িং ফিল্ড গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতেই হবে, এর বিকল্প নেই আর।

আমরা আমাদের কর্মক্ষেত্রগুলোতে প্রতিদিনই নানারকম পক্ষপাতের মুখোমুখি হচ্ছি, প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়ছি, কখনও কখনও রুখে দাঁড়ালেও সম্মিলিত প্রয়াসের অভাবে তা মূলত কাজে আসে না, উপরন্তু চাকরিচ্যুতি থেকে শুরু করে নানারকম হয়রানির শিকার হতে হয় আমাদের। তাই সংঘবদ্ধ হওয়ার কোন বিকল্প নেই। তথ্য প্রযুক্তির এই বিকাশমান ধারায় নারীর এগিয়ে যাওয়ার বিকল্পও নেই। নারী এগিয়ে যাচ্ছেও। যদিও সেই সংখ্যাটা আনুপাতিক হারে এখনও তেমন উল্লেখযোগ্য নয়।

আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো প্রতিনিয়তই এই সংঘবদ্ধ হয়ে কাজ করাকে উৎসাহিত করে যাচ্ছে। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশে তাদের কার্যক্রম আছে। তারপরও কেন নারীদের সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ এতোটা পক্ষপাতদুষ্ট?  এমনকি ছোটবেলা থেকে স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব পক্ষপাতের সম্মুখীন আমরা হই, তার প্রতিও সরব হওয়া প্রয়োজন থাকলেও কেন আমরা তা পারছি না?

পথ একটাই সামনে। নারীর অর্জনকে উদযাপন করা জানতে হবে, করতে হবে। যেকোনো ধরনের পক্ষপাত ও বৈষম্যমূলক আচরণের বিরোধিতা করতে হবে, সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। সমতাপূর্ণ বিশ্ব তৈরির লক্ষ্যে কাজ করে যেতে হবে, পদক্ষেপ নিতে হবে। এভাবেই একদিন পক্ষপাতের চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়তে বাধ্য।

সুপ্রীতি ধর, সাংবাদিক, লেখক এবং অধিকারকর্মী

অস্থির সময়ে স্বস্তির জন্য মেডিটেশন

আমাদের জীবন দিনে দিনে জটিল হচ্ছে। অফিস, পরিবার, রান্না, খাওয়া ছাড়াও আছে হাজার রকমের চিন্তা। সোশ্যাল মিডিয়ার বদৌলতে পৃথিবীর সবকিছু সম্পর্কে সহজে জানা সেই সঙ্গে চিন্তা-ভাবনা, চাওয়া-পাওয়ার ধরন পরিবর্তন হয়েছে। সবকিছু সহজলভ্যতার কারণে প্রত্যাশা-প্রাপ্তি নিয়ে তৈরি হয়েছে নানা মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা। সময়ের সঙ্গে এসব মনস্তাত্ত্বিক চাপের কারণে ভেতরে তৈরি হয় অস্থিরতা। এই অস্থিরতাকে নিজের ভেতরে পুষে রাখলে ডিপ্রেশনসহ নানা মানসিক রোগের উৎপত্তি হতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড হেলথ পাবলিশিং-এর ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২১-এর রিপোর্ট অনুসারে, ডিপ্রেশনের কার্যকরী সমাধান হলো মেডিটেশন।

২০২০ সালে চীনে চিকিৎসক ও রোগীর সম্পর্ক নিয়ে একটি গবেষণা হয়। এতে ১০৬ জন চিকিৎসককে দুটি গ্রুপে ভাগ করা হয়। একটি গ্রুপকে আট সপ্তাহব্যাপী মেডিটেশন প্রোগ্রামে যুক্ত করা হয়। আরেকটি গ্রুপ তাদের চিরাচরিত রুটিনেই জীবনযাপন করেন। দেখা গেছে, ধ্যানী চিকিৎসকরা রোগীদের প্রতি সহমর্মী হয়ে উঠেছেন। রোগীর সাথে কথোপকথনে তারা আগের চেয়ে মনোযোগী।

যুক্তরাষ্ট্রের রচেস্টার স্কুল অব মেডিসিন এন্ড ডেন্টিস্ট্রির প্যালিয়েটিভ কেয়ার বিশেষজ্ঞ, লেখক ও কমিউনিকেশন এন্ড মাইন্ডফুল প্র্যাকটিস ইন মেডিসিনের শিক্ষক রোনাল্ড এম. এপস্টেইন বলেন, "চিকিৎসক এবং চিকিৎসাপেশায় নিয়োজিতদের মধ্যে যারা মেডিটেশন করেন, তারা রোগীদের সাথে কথা বলায় অধিক মনোযোগী। পেশাগত ত্রুটি শুধরে নিতে আন্তরিক এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণেও তৎপর। পেশাগত চাপ তাদের ওপর কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে না।"

বিশ্ব জুড়ে এখন প্রায় ৫০ কোটি মানুষ নিয়মিত ধ্যান বা মেডিটেশন করেন। শারীরিক মানসিক সামাজিক ও আত্মিক অর্থাৎ সুস্থ থাকতে মেডিটেশন বা ধ্যানের কার্যকারিতা এখন চিকিৎসাবিজ্ঞানে প্রমাণিত।

পুরো বিশ্বের মত আমাদের দেশেও দিনদিন মেডিটেশনের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। পরিপূর্ণ সুস্থতার জন্য বিদ্যমান চিকিৎসার পাশাপাশি মেডিটেশন যে প্রয়োজন, সেই পরামর্শ এখন চিকিৎসকরা দিচ্ছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সম্প্রতি যোগ-মেডিটেশনকে স্বাস্থ্যসেবার পরিপূরক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছে। 

নিজের অস্থিরতাকে সংযম করতে হবে নিজের শান্তির জন্য। কাজের চাপ, ব্যস্ততায় অস্থিরতা কিছু সময়ের জন্য ভুলে থাকা গেলে ও একেবারে নির্মূল হয়ে যায় না। মানসিক অস্থিরতা দূর করার জন্য মেডিটেশন খুব কাজ দেয়। মেডিটেশন করলে বিভিন্ন সুবিধা লাভ করা সম্ভব।

ধ্যান বসে বা শুয়ে—যেকোনো অবস্থাতেই করা যায়। যেকোনো সময়, খাওয়ার আগে বা পরে, সকালে, বিকেলে বা রাতে এবং যতক্ষণ ইচ্ছা করা যায়। ধ্যানের ক্ষেত্রে কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম বা বিধিনিষেধ নেই। তাই যখনই সুযোগ পাওয়া যায়, মেডিটেশন বা ধ্যান করে নেওয়া যায়। প্রতিদিন ৫ মিনিটের ধ্যানও দিতে পারে একটি নিয়ন্ত্রিত সুশৃঙ্খল জীবন আর সেই সঙ্গে অনাবিল প্রশান্তি।

ধ্যানের সময় ও স্থান

মেডিটেশন শুরুর আগে প্রথমেই এ কথা আসতে পারে যে কতক্ষণ এই মেডিটেশন করলে, তার সুফল পাওয়া যেতে পারে। জবাব হলো, প্রথম দিকে স্থির করে নিতে হবে কতটা সময় ধরে মেডিটেশন করা উচিত। ৫ থেকে ১০ মিনিট বা ১ ঘণ্টাও এটি করা যেতে পারে। আর এর জন্য বেছে নিতে হবে শব্দহীন ও নিরিবিলি একটি জায়গা।

আরামদায়ক হোক ধ্যানের সময়টুকু

মেডিটেশন করার ক্ষেত্রে কোথায় বসে তা করা উচিত, তা নিয়ে অনেকের মনেই প্রশ্ন থাকতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, এ ক্ষেত্রে প্রাধান্য দিতে হবে দেহের স্বস্তিকে। ধ্যান করতে বসে বা শুয়ে যদি আরাম বোধ না হয় তাহলে ধ্যানে মনোযোগ আসবে না। খেয়াল রাখতে হবে, হাত, পায়ের অবস্থান ও বসার ভঙ্গি যেন আরামদায়ক হয়।

আর্কাইভস আর্কাইভস ১

ধ্যান যেভাবে করবেন

শ্বাস গ্রহণ ও ছাড়ার সময় নিশাস-প্রশ্বাসের মুভমেন্ট অনুসরণ করতে হবে। শ্বাস ভেতরে যাওয়া এবং বের হওয়ার প্রক্রিয়ার ওপর নজর দিতে হবে। মেডিটেশেনের সময় মানসিক স্থিতি এমন হবে, যাতে মন অন্য কোনো ভাবনায় বুঁদ না হয়ে পড়ে। শরীর, সাম্প্রতিক অবস্থা, সবকিছু ছাড়িয়ে যেতে দিতে হবে নিজের মনকে। মনকে স্থির করতে হবে যেকোনো একটি নির্দিষ্ট বিন্দু বা বিষয়ের ওপর।

ধ্যান শেষ হলে করণীয়

মেডিটেশন শেষ হলে তাড়াহুড়ো করে উঠে পড়া সমীচীন নয়। ধীরে ধীরে একটি অবস্থা থেকে মনকে সরিয়ে নিতে হবে। তারপর দেহ ও মনকে সজাগ করুন। তারপর ধীরে ধীরে মেডিটেশন ছেড়ে ওঠা উচিত।

নিয়মিত ধ্যানের উপকারিতা

    মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে ধ্যান।
    দেহ ও মনের সুস্থতার জন্য যেমন ধ্যান প্রয়োজনীয়, তেমনি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ও কর্মক্ষেত্রে উন্নতি করতে ধ্যানের জুড়ি নেই।
    জীবন সুন্দর করতে ও সময়কে উপভোগ করতেও সাহায্য করে ধ্যান। ধ্যানের অভ্যাস গড়ে তুললে যেকোনো অবস্থানে সুখী হওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়। দেহ ও মনের সৌন্দর্যও বৃদ্ধি করে ধ্যান।

এ ছাড়া প্যানিক অ্যাটাক, মানসিক ভীতি কম করা ও আত্মবিশ্বাস বাড়াতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মেডিটেশন। তবে আমাদের দেশে অপ্রচলিত বলে কোথা থেকে মেডিটেশন শুরু করবে, কীভাবে চালিয়ে যাবে এসব বিষয়ে ধারণা কম। মেডিটেশন করার জন্য বর্তমানে বিভিন্ন অ্যাপ প্রচলিত আছে। যেমন- ওরা, ব্রিদিং প্লাস, টেন পার্সেন্ট হ্যাপিয়ার, মাইন্ডফুলনেস উইথ পেটিট ব্যামব্যু, মাইন্ডফুলনেস অ্যাপ, স্মাইলিং মাইন্ড, ওমভানা। এগুলো সঠিক পদ্ধতিতে মেডিটেশন করতে সাহায্য করে।

চাই সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষার বাজেট

আর দুই মাসের মধ্যেই মহান জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা হবে আসন্ন ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট। এটি হবে সরকারের নতুন অর্থমন্ত্রীর প্রথম বাজেট। আগামী পাঁচ বছরের অর্থনৈতিক ভিত্তি বছর হিসেবে আসন্ন অর্থবছরের বাজেট তাই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া, ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা ও দেশীয় উচ্চ মূল্যস্ফীতির বাস্তবতায় পেশ হতে যাচ্ছে আগামী বাজেট।

এই প্রেক্ষাপটে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রশ্নটি এবারে মুখ্য বলে বিবেচিত হবার কথা। তাই বরাবর যে মাত্রায় প্রস্তাবিত বাজেটের আকার বাড়ানো হয় এবার তা হচ্ছে না বলেই মনে হয়। সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষার স্বার্থেই এবার সঙ্কোচনমুখী বাজেট হতে যাচ্ছে।

ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগ প্রবাহ অতোটা বলশালী না হওয়ায় আমাদের প্রবৃদ্ধি মূলত নির্ভর করে সরকারি ব্যয়ের ওপর। কাজেই কাটছাটের বাজেট করলে প্রবৃদ্ধির চাকা তুলনামূলক কম গতিশীল থাকবে। এমনিতেই চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার কমে এসেছে। ২০২৩-এর অক্টোবরে আইএমএফ চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশ হবে বলে প্রক্ষেপণ করলেও এ বছরের এপ্রিলের মাঝামাঝি এসে তা কমিয়ে ৫.৭ শতাংশ করেছে। এ অবস্থায় কাটছাটের বাজেট করলে আসছে অর্থবছরেও প্রবৃদ্ধি খুব গতিশীল হবে না- এ কথা বলাই যায়। ভোগ ও বিনিয়োগ সঙ্কোচনের কারণেই যে এমনটি আশংকা করা হচ্ছে তা বলাই বাহুল্য।

তবে আমার মতে প্রবৃদ্ধি নয়, বরং আসছে বছরে মনোযোগ দিতে হবে সামষ্টিক-অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষার দিকেই। সে জন্য সঙ্কোচনমুখী বাজেটই কাম্য। এ প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো যে, প্রবৃদ্ধির চাকা কিছুটা ধীর হয়ে আসলেও বৈশ্বিক বাস্তবতার বিচারে বাংলাদেশ তুলনামূলক বর্ধিষ্ণু অর্থনীতিগুলোর কাতারেই থাকবে। কেননা অল্প কিছু ব্যতিক্রম বাদে গোটা বিশ্বেই প্রবৃদ্ধি ধীর হয়ে আসছে। আর হালের ইরান-ইসরায়েল ভূ-রাজনৈতিক টানাপোড়েনের কারণে এই আশঙ্কা আরও ঘনিভূত হচ্ছে।

আসছে অর্থবছরে যেহেতু তুলনামূলক সঙ্কোচনমুখী বাজেট হতে যাচ্ছে, সেহেতু সীমিত সম্পদের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে বরাদ্দের অগ্রাধিকার নিশ্চিত করার সময়ও বাজেটপ্রণেতাদের বরাবরের চেয়ে বেশি সংবেদনশীল হতে হবে। তবে সম্পদ বরাদ্দের যথাযথ অগ্রাধিকার (বাজেটের ব্যয়ের দিক) নিশ্চিত করার পাশাপাশি সম্পদ সমাবেশ অর্থাৎ বাজেটের আয়ের দিক নিয়েও একই রকম সংবেদনশীলতা কাম্য। বেশ কয়েক বছর ধরেই অর্থনীতিবিদেরা বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত বাড়ানোর দিকে নীতি-মনোযোগ আকর্ষণ করে আসছেন। জিডিপির শতাংশ হিসেবে সরকারের আহরিত করের পরিমাণ ১০ শতাংশের নিচেই রয়ে যাচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগিরাও এখন কর-জিডিপি অনুপাত বাড়ানোকে একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক সংস্কার হিসেবে চিহ্নিত করেছে। আসন্ন বাজেটে এই সংস্কারের প্রতিফলন ঘটার সম্ভাবনা যথেষ্ট।

ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং আমাদের বহিঃঅর্থনীতি নিয়ে টানাপোড়েনের কারণে আমদানি কমেছে। তাই রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়ছে। পাশাপাশি বহিঃঅর্থনীতির সঙ্কটের কারণে মোটাদাগে ব্যবসা-বাণিজ্যের গতিই কমে এসেছে। এ কারণেও রাজস্ব আহরণ কঠিন হয়ে পড়েছে। চলতি অর্থবছরে ৪ লক্ষ ৩০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। এই পরিমাণ তার আগের অর্থবছরের চেয়ে ৩০ শতাংশ বেশি।

সাম্প্রতিক অর্থবছরগুলোর কোনটিতেই রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পুরোপুরি অর্জন করা সম্ভব হয়নি। সামষ্টিক-অর্থনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে এ বছরও এত বড় লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। তাই পরবর্তিতে চলতি অর্থবছরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ৪ লক্ষ ১০ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে। গণমাধ্যমের খবর থেকে জানা যাচ্ছে যে, অর্থবছরের প্রথম আট মাসে এই কমিয়ে আনা লক্ষ্যমাত্রার ৫৫ শতাংশের কিছু বেশি অর্জন করা গেছে।

রাজস্ব আহরণের দক্ষতা বাড়াতে এই প্রক্রিয়ার পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাইজেশনের যে কোনও বিকল্প নেই সে কথাটি বার বার সামনে আনছেন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের অংশীজনেরা। এনবিআর-সহ সংশ্লিষ্ট নীতি-নির্ধারকরাও এ বিষয়ে যথেষ্ট উদ্যোগী হয়েছেন। আসছে অর্থবছর থেকে ১০ লক্ষ টাকা বা এর বেশি ভ্যাট পরিশোধের জন্য ই-পেমেন্ট বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। বর্তমানে ৫০ লক্ষ টাকা বা তার বেশি ভ্যাট পরিশোধে ই-পেমেন্ট বাধ্যতামূলক। এছাড়া ইলেকট্রনিকস টেক্সট ডিটেকশন সোর্স (ইটিডিএস) অনলাইন প্ল্যাটফরম চালুর পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়া নতুন করদাতাদের কর জালে আনতে বিআরটিএ,  সিটি করপোরেশন, ডিপিডিসির সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করার পরিকল্পনা নিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড।

ডিজিটাইজেশনকে অগ্রাধিকার দিয়ে রাজস্ব আহরণ প্রক্রিয়াকে আরও দক্ষ করতে নেওয়া এনবিআর-এর এ সমস্ত উদ্যোগ যত দ্রুত বাস্তবায়ন করা যাবে ততই মঙ্গল। উল্লেখ্য, প্রায় এক কোটির মতো টিনধারীর মাত্র এক তৃতীয়াংশ বাস্তবে কর দেন। বাদবাকিদের করজালে আনার জন্য নতুন করে ভাবনার সুযোগ রয়েছে বলে মনে হয়। সে ভাবনার অংশ হিসেবেই আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স বা এআই এর ব্যবহার করা যেতে পারে।

রাজস্ব আহরণ বাড়াতে ঢালাওভাবে করের বোঝা বাড়াতে হবে- এ ধারণা এখন সেকেলে হয়ে গেছে। বরং করছাড় দিয়ে বেশি বেশি করদাতাকে কর প্রদানে উৎসাহিত করতে পারলে রাজস্ব আহরণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়তে পারে। বাংলাদেশের ফরেন ইনভেস্টরস’ চেম্বার অফ কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রি (ফিকি)-এর গবেষণায় দেখা গেছে যে, ২০২২ থেকে ২০৪১ সময়কালের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্যে আরোপিত কর ৩৩ শতাংশ কমানো গেলে ওই সময়ের ব্যবধানে ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে সরকারের রাজস্ব ৩৪ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ২২৭ বিলিয়ন ডলারে উন্নিত হবে (যা জিডিপির প্রায় ১০ শতাংশের সমান হবে)।

শুধু তাই নয়, এর ফলে জিডিপির শতাংশ হিসেবে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগও ২.২ শতাংশে উন্নিত হবে (বর্তমানে ০.৩ শতাংশ)।

দেখা যাচ্ছে, ঢালাওভাবে আরোপিত কর না বাড়িয়ে ক্ষেত্রবিশেষে করছাড় দিয়েও রাজস্ব আহরণ বাড়ানো সম্ভব। করছাড় দেওয়ার ক্ষেত্রে কোন খাতগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত সেটি নিয়েও নীতি-নির্ধারকদের ভাবতে হবে। এক্ষেত্রে কৃষিকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে। পুরো অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি সাম্প্রতিক কালে কমতে থাকলেও কৃষির ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি আমাদের সুরক্ষা দিয়ে চলেছে। বিবিএস-এর পরিসংখ্যান মতে চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে শিল্প এবং সেবা খাতের পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট প্রবৃদ্ধি কমেছে (যথাক্রমে ১০ শতাংশ থেকে কমে ৩.২৪ শতাংশ এবং ৬.৬২ শতাংশ থেকে কমে ৩.০৬ শতাংশ হয়েছে)। অথচ কৃষির ক্ষেত্রে এই পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট প্রবৃদ্ধির হার কমে না গিয়ে বরং বেড়েছে (৪.২২ থেকে বেড়ে ৪.৬৫ শতাংশ হয়েছে)। আসন্ন অর্থবছরে বরাদ্দ দেওয়ার সময় সামষ্টিক অর্থনীতির রক্ষাকবচ হিসেবে কৃষির এই ভূমিকাটি আমাদের বাজেট প্রণেতারা নিশ্চয় বিবেচনায় রাখবেন। তাদের কাছে প্রত্যাশা থাকবে কৃষি খাতে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় ভর্তুকি দেওয়ার যে প্রশংসনীয় ধারা তারা বিগত দেড় দশকে তৈরি করেছেন তা আসছে বছরেও বহাল রাখবেন। এছাড়াও কিছু রাজস্ব সুবিধা বাড়িয়েও কৃষিকে প্রণোদিত করা যায়। যেমন, বিভিন্ন কৃষি ইনপুটস (যেমন: সার, বীজ, ইত্যাদি)-এর ওপর আরোপিত ভ্যাট কিংবা রেগুলেটরি শুল্কের ক্ষেত্রে কিছু ছাড় দিলে কৃষি উৎপাদক থেকে শুরু করে ভোক্তা পর্যন্ত সকলেই এর সুবিধা পাবেন। একই কথা তথ্যপ্রযুক্তি-নির্ভর পণ্য ও সেবার বেলায় খাটে। এই খাত ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছে। কিছুতেই এই খাতকে দেওয়া করছাড় তুলে নেওয়া ঠিক হবে না। এমন কি বস্ত্রখাতে দেওয়া কর সুবিধেও খুব চিন্তাভাবনা করে ধীরে ধীরে তুলে নেবার কথা ভাবতে হবে।

কর আহরণ বিষয়ক অনুশীলনগুলোতে কিছু পরিবর্তন করে বিদ্যমান উৎসগুলো থেকেও আরও বেশি বেশি কর আদায় সম্ভব। যেমন, সিগারেটের দাম প্রতি বছর বাজেটে অল্প অল্প করে বাড়ানো হয়। কিন্তু তামাক-বিরোধী গবেষকদের হিসাব থেকে দেখা যাচ্ছে এই ক্ষতিকারক পণ্যটির দাম এক ধাক্কায় অনেকখানি বাড়িয়ে তার থেকে কর আহরণ করলে, একদিকে সিগারেটের ব্যবহার যেমন উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমবে, অন্যদিকে- সিগারেট বিক্রি থেকে আরও বাড়তি ১০ হাজার কোটি টাকা কর পাওয়া সম্ভব।

রাজস্ব আদায় তথা বাজেটের আয়ের দিককে বলশালী করতে আসছে বছরে নিশ্চয় বাজেটপ্রণেতারা নতুন নতুন সময়োচিত উদ্ভাবনী নীতি-উদ্যোগ নিবেন। তারপরও (আগেই যেমনটি বলেছি) বিদ্যমান ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং আমাদের নিজস্ব সামষ্টিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলোর প্রেক্ষাপটে আসছে অর্থবছরে বাস্তবতার প্রতি সংবেদনশীল একটি ব্যয় পরিকল্পনাই দরকার। এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু প্রস্তাবনা এখানে তুলে ধরতে চাই-

০১) মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে জনগণকে বিশেষত নিম্ন আয়শ্রেণির পরিবারগুলো সুরক্ষিত রাখাকেই প্রধানতম অগ্রাধিকার হিসেবে দেখতে হবে। ইতোমধ্যে ওএমএস কার্যক্রম এবং এক কোটি পরিবারকে কার্ডের মাধ্যমে কম দামে নিত্যপণ্য সরবরাহ করার উদ্যোগগুলো বিশেষ কার্যকর হয়েছে। এসব কর্মসূচির পরিধি বাড়ানো এবং এমন নতুন নতুন সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে (বিশেষত নগরাঞ্চলের জন্য) বেশি বেশি বরাদ্দ দিতে হবে।

০২) জ্বালানির দাম সমন্বয়ের উদ্যোগ ধাপে ধাপে বাস্তবায়িত হচ্ছে। এর প্রভাব বিদ্যুৎ ও পরিবহন খাতে পড়েছে। এরই মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে অস্থিরতা তৈরি হওয়ায় বলা যায়- নিশ্চিতভাবেই আসছে অর্থবছরে বিশ্ব বাজারে জ্বালানির দামে অস্থিরতা থাকবে। জ্বালানির দাম খুব বেশি বেড়ে গেলে দরকারবোধে বাড়তি ভর্তুকি দেয়ার জন্য কিছু সম্পদ বাজেটে আলাদা করে বরাদ্দ করা যেতে পারে। জনগণকে স্বস্তি দিতে এলপি গ্যাসে কিছু রাজস্ব ছাড়ের কথাও বিবেচনা করা যায়।

০৩) জ্বালানি কেনাকাটার জন্য আমরা বেশি মাত্রায় ব্যক্তি খাতের ওপর নির্ভরশীল। সরকার এ ক্ষেত্রে ব্যক্তি খাতের গ্যারান্টর হিসেবে ভূমিকা রাখে। সরকার নিজে সরাসরি আন্তর্জাতিক বাজার থেকে এলএনজি কেনা শুরু করলে কিছুটা সুবিধা পাওয়া যায় কিনা সেটা ভেবে দেখা দরকার। নতুন নতুন গ্যাস ক্ষেত্র অনুসন্ধানের কার্যক্রমও শুরু হবার পথে। দেরিতে হলেও এটি একটি ইতিবাচক উদ্যোগ। পাশাপাশি সবুজ জ্বালানির ক্ষেত্রগুলো আরও প্রসারিত করার জন্য বাজেটারি উদ্যোগ নিতে হবে।

০৪) যেহেতু কৃষিই আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতির রক্ষাকবচ, তাই বিভিন্ন কৃষি ইনপুটস-এ যতোটা সম্ভব করছাড় দেয়ার কথা বিবেচনায় রাখতে হবে। পাশাপাশি কৃষি খাতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণের ভর্তুকি দেয়ার ধারাবাহিকতাও বজায় রাখতে হবে। কেননা কৃষিতে দেওয়া এই ভর্তুকি মূলত এক ধরনের গণমুখী বিনিয়োগ। কৃষির সুরক্ষায় নেওয়া বাজেটারি উদ্যোগগুলো দেশের কর্মসংস্থান ও খাদ্য নিরাপত্তায়ও ভূমিকা রাখবে।

০৫) প্রবাসী আয় প্রবাহ বলশালী করার ক্ষেত্রে শ্রমিকদের দক্ষতা একটি বড় প্রতিবন্ধক। এ লক্ষ্যে প্রবাসগামি শ্রমিকদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য বাজেট বরাদ্দে বিশেষ মনোযোগ নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ করে শিক্ষায় বরাদ্দের ক্ষেত্রে কারিগরি শিক্ষাকে যথাযথ অগ্রাধিকার দিতে হবে। শিখন ও প্রশিক্ষণে বাড়তি নীতি সমর্থন দিয়ে যেতে হবে।

০৬) অবকাঠামোগত উন্নয়নে বরাদ্দের ক্ষেত্রে সংযমি হতেই হবে। তবে যে সমস্ত প্রকল্প দেশের শিল্পায়নকে গতিশীল করবে এবং নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারবে সেগুলোকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করে যথাযথ বরাদ্দ দিতে হবে।

০৭) অভ্যন্তরীণ রাজস্ব বাড়ানোর জন্য এবারের বাজেটে হয়তো কর-ছাড় ও ও প্রণোদনার নানা দিক যৌক্তিক করার উদ্যোগ নেওয়া হবে।  নিঃসন্দেহে এমন সংস্কার কাম্য। তবে এক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে যেন এগুলোর ফলে দেশের শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থান বাধাগ্রস্ত না হয়। বিশেষ করে সাত’শরও বেশি এমএফআইগুলো যে ছোটখাটো ঋণ দেয় তার এক-তৃতীয়াংশ যায় কৃষিতে। আরেকটি বড় অংশ যায় এমএসএমই খাতে। এর বেশিরভাগ সুবিধা পায় নারী ও প্রান্তিক উদ্যোক্তরাই। এমএফআইকেও তাই করারোপের প্রক্রিয়া থেকে দূরে রাখাই শ্রেয় হবে। এ খাতে করারোপ করলে গ্রামীণ ভোগ কমে যাবে। ভ্যাট আহরণও কমে যেতে পারে।

০৮) পুরো জলবায়ু অর্থায়নের বিষয়টিকেই বেশি বেশি গুরুত্ব দিতে হাবে আগামী দিনের বাজেটগুলোতে। বাংলাদেশকে জলবায়ু তহবিলের ন্যায্য হিস্যা দিতে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগিরা বিশেষভাবে আগ্রহী। তাই জাতীয় বাজেটে জলবায়ু-বান্ধব উন্নয়ন প্রকল্পগুলোকে বেশি অগ্রাধিকার দিতে পারলে সে জন্য আন্তর্জাতিক সমর্থন পাওয়া সহজ হবে। বাজেটপ্রণেতাদের তাই প্রতিটি খাতের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোকে যতোটা সম্ভব জলবায়ু-সংবেদনশীল করে সাজাতে হবে।

সর্বোপরি বাজেট এবং মুদ্রানীতির একটি কার্যকর ও সময়োচিত সমন্বয় নিশ্চিত করার বিষয়ে সর্বোচ্চ নীতি-মনোযোগ নিশ্চিত করতেই হবে। কেননা বহিঃঅর্থনীতির চ্যালেঞ্জ, রিজার্ভ ক্ষয়রোধ, ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতা নিশ্চিতকরণ, বিনিময় হারে ভারসাম্য রক্ষার মতো বড় চ্যালেঞ্জগেুলো মোকাবিলা করতে সরকারের বাজেট এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতির মধ্যে সমন্বয় নিশ্চিত করার কোনও বিকল্প নেই। আসছে বছরে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষার বাজেট প্রণয়নের সময় আমাদের নীতি-নির্ধারকরা এ বিষয়টি বিবেচনায় রাখবেন বলেই আশা করি।

লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক