‘বইমেলা’ কিংবা ‘গ্রন্থমেলা’ শব্দ দুটি যেন বাঙালির প্রাণের স্পন্দে স্পন্দে রন্ধিত রয়েছে। ‘বইমেলা’ কিংবা ‘গ্রন্থমেলা’ শব্দ দু’টির যেকোনো একটি শুনলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে বাংলা একাডেমী আয়োজিত অমর একুশে বইমেলা। যে মেলা বইপ্রেমী মানুষের প্রাণে দোলা দেয়। কোনো এক অদৃশ্য শক্তিবলে লাখো মানুষকে টেনে আনে একাডেমীর বর্ধমান হাউস প্রাঙ্গণে।
বর্ধমান হাউস ও এর আশপাশ ঘিরে জমে ওঠে লেখকদের জমজমাট আড্ডা। কাটে লেখক প্রকাশকদের নির্ঘুম রাত। প্রকাশিত হয় হাজার হাজার বই। তেমনি নতুন বইয়ের মৌ মৌ গন্ধে মোহিত হয়ে মেলায় ছুটে আসে ক্রেতা, দর্শনার্থী। বিক্রি হয় লাখ লাখ কপি বই।
ভিড় ঠেলে প্রয়োজনীয় বইটি হাতে পাওয়ার পর আনন্দে চিক চিক করে ওঠে মুখ। তারপর বইটি বগলদাবা করে প্রিয় লেখকের অটোগ্রাফ নেওয়ার চেষ্টা। মঞ্চের সামনে বসে আলোচনা কিংবা দাঁড়িয়ে একটু গান শোনা। এসবই আমাদের কাছে খুব চেনা এবং জানা একটি বিষয়। কিন্তু আমরা অনেকেই এই মেলার ইতিহাস জানি না। চলো টচ করে জেনে নেই অমর একুশে গ্রন্থমেলার ইতিহাস।

বাংলাদেশের প্রথম বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৬৫ সালে তৎকালীন কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরিতে (বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি)। এটি ছিল মূলত শিশু গ্রন্থমেলা, যার আয়োজন করেছিলেন কথাসাহিত্যিক সরদার জয়েনউদদীন। তিনি একসময় বাংলা একাডেমিতে চাকরি করতেন। এরপর আরো বড় আয়োজনে গ্রন্থমেলা করার সুযোগ খুঁজতে থাকেন তিনি।

১৯৭০ সালে নারায়ণগঞ্জ ক্লাবের সহযোগিতায় নারায়ণগঞ্জে একটি গ্রন্থমেলার আয়োজন করেন তিনি। এই মেলায় আলোচনা সভারও ব্যবস্থা ছিল যাতে অংশ নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের তৎকালীন প্রধান অধ্যাপক মুহাম্মদ আব্দুল হাই, শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী ও সরদার ফজলুল করিম।
বাংলা একাডেমিতে অনুষ্ঠিত বইমেলার ইতিহাস স্বাধীন বাংলাদেশের মতোই পুরনো। তবে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই বাংলা একাডেমিতে একুশের অনুষ্ঠানে কোনো বইমেলা হয়নি। তখন একাডেমির দেয়ালের বাইরে স্ট্যান্ডার্ড পাবলিশার্সের রুহুল আমিন নিজামী তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রগতি প্রকাশনীর কিছু বইয়ের পসরা সাজিয়ে বসেন ১৯৭২ সালে।
.jpg)
১৯৭২ সাল ৮ ফেব্রুয়ারি মুক্তধারা প্রকাশনীর চিত্তরঞ্জন সাহা একটা চটের ওপর কলকাতা থেকে আনা ৩২টি বই সাজিয়ে বসে পড়েন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন বর্ধমান হাউস প্রাঙ্গণের বটতলায়।
এ ৩২টি বই ছিল চিত্তরঞ্জন সাহা প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ (বর্তমান মুক্তধারা প্রকাশনী) থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশি শরণার্থী লেখকদের লেখা। সে বছর বাংলা একাডেমিও একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে হ্রাসকৃত মূল্যে বই বিক্রি করেছিল।
তবে চিত্তরঞ্জন সাহার স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ (পরে মুক্তধারা প্রকাশনী) ছিল একমাত্র বেসরকারি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। ওই সময় বর্ণমিছিলের তাজুল ইসলামসহ আরো কিছু প্রকাশক একাডেমির ভেতরে পূর্ব দিকের দেয়াল ঘেঁষে বই সাজিয়ে বসেন। এভাবেই চলতে থাকে আগামী কয়েক বছর।

১৯৭৩ সালে বাংলা একাডেমি মেলা উপলক্ষে ১৫ থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিশেষ হ্রাসকৃত মূল্যে নিজেদের প্রকাশিত বই বিক্রির ব্যবস্থা করে। এর পাশাপাশি মুক্তধারা, স্ট্যান্ডার্ড পাবলিশার্স ও তাদের দেখাদেখি আরো অনেকে বাংলা একাডেমির মাঠে নিজেদের বই বিক্রির উদ্যোগ নেয়।

১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমী ১৪ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজন করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐ সম্মেলনের উদ্বোধন করেন। এ উপলক্ষে বাংলা একাডেমী তার নিজস্ব প্রকাশিত বই প্রদর্শন ও ম্যুরাল প্রদর্শনীর আয়োজন করে। বই প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন প্রফেসর আবু মহাম্মেদ হবীবুল্লাহ।
ঐ গণজমায়েতকে সামনে রেখে ঢাকার বিভিন্ন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান একাডেমীর পূর্বদিকের দেয়াল বরাবর নিজেদের পছন্দমতো জায়গায় যে যার মতো কিছু স্টল নির্মাণ করে বই বিক্রির ব্যবস্থা করে। এতে বাংলা একাডেমীর কোনো ভূমিকা ছিলো না শুধু মাঠের জায়গাটুকু দেওয়া ছাড়া।

১৯৭৫ সালে একাডেমী মাঠের কিছু জায়গা চুনের দাগ দিয়ে প্রকাশকদের জন্য নির্দিষ্ট করে দেয়। প্রকাশকরা যে যার মতো স্টল তৈরি করে বই বিক্রির ব্যবস্থা করে। এ অবস্থা চলতে থাকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত। এ সময় পর্যন্ত এই আয়োজনের কোনো স্বীকৃতি ছিলো না। কোনো নামও দেওয়া হয়নি। সংবাদপত্রের প্রতিবেদনেও এরন কোনো উল্লেখ থাকতো না।
১৯৭২ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত বাংলা একাডেমীর অনুষ্ঠানসূচিতেও এই কার্যক্রমের কোনো উল্লেখ করা হয়নি।

১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমীর তৎকালীন মহাপরিচালক আশরাফ সিদ্দিকী বাংলা একাডেমীকে মেলার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত করেন।
১৯৭৯ সালে মেলার সঙ্গে যুক্ত হয় বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি। এই সংস্থাটিও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন চিত্তরঞ্জন সাহা। মেলার তখন নাম ছিলো একুশে গ্রন্থমেলা।

১৯৭৯ সাল থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত এই নিয়মেই ‘একুশে গ্রন্থমেলা’ পালিত হয়।
১৯৮১ সালে ‘একুশে গ্রন্থমেলায় পরিবর্তন আনে বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ। ‘একুশে গ্রন্থমেলা’র মেয়াদ কমিয়ে ২১ দিনের পরিবর্তে ১৪ দিন ধার্য করে বাংলা একাডেমি। কিন্তু প্রকাশকরা বাংলা একাডেমির এ সিন্ধান্ত মেনে নিতে পারেনি। তারা বাংলা একাডেমির এ সিন্ধান্তের বিরুদ্ধে তাদের দাবি তুলে ধরে।
প্রকাশকদের এ দাবির মুখে ১৯৮২ সালে ‘একুশে গ্রন্থমেলা’র মেয়াদ পুনরায় বৃদ্ধি করতে বাধ্য হয়ে পূণরায় মেলার মেয়াদ করা হয় ২১ দিন করে এবং মেলার উদ্যোক্তা হিসেবে বাংলা একাডেমি সে মেলার আয়োজন করে। ১৯৮২ সালের ঐ মেলায় সহযোগি হিসেবে ছিল জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র এবং বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি।
১৯৮৩ সালে বাংলা একাডেমির মহা পরিচালক হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন কাজী মনজুরে মওলা। তিনি বিশেষ কারণে সহযোগি প্রতিষ্ঠান থেকে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রকে বাংলা একাডেমি বাদ দিয়ে দেয়। কি কারণে বাদ দিয়ে দেয় সে তথ্য বাংলা একাডেমি প্রকাশ করেনি। বরং বাংলা একাডেমি সে সময় প্রচার করে ‘একুশে বইমেলা’কে নতুন আঙ্গিকে প্রসার করার কারণেই জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রকে বাদ দেওয়া হয়েছে। ধুমধাম করে বাংলা একাডেমি ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’র আয়োজন শেষ করে কিন্তু সৈ¦রশাসক এরশাদ-এর সরকারের বিরুদ্ধে শিক্ষা ভবনের সামনে ছাত্রদের বিক্ষোভ মিছিলে ট্রাক তুলে দিলে দুজন ছাত্র নিহত হয়। ওই মর্মান্তিক ঘটনার পর সেই বছর আর বইমেলা করা সম্ভব হয়নি।
১৯৮৪ সালে বাংলা একাডেমি আবার ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’র পুণ আয়োজন করে। ৫২’র ভাষা আন্দোলনে শহিদদের উপর আরও গভীর শ্রদ্ধা দেখাতে ‘একুশে গ্রন্থমেলা’র পরিবর্তে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ নামকরণ ১৯৮৩ সালে করলেও ১৯৮৪ সালে তার কার্যকারিতা সফল করে বাংলা একাডেমি। সেই সাথে প্রকাশকদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে স্টলের সংখ্যা বাড়ানো হয়, সেই সাথে মেলার পরিসরও বাড়তে থাকে। আস্তে আস্তে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’র বিভিন্ন ফিচার সংবাদ প্রকাশিত হতে থাকে। শ্রী চিত্তরঞ্জন সাহার ৩২টি বইয়ের ক্ষুদ্র সে মেলাটি কালানুক্রমে বাঙালির প্রাণের ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলাতে পরিণত হতে শুরু করে। পাঠকের সংখ্যাও ব্যাপকভাবে চোখে পড়ার মতো হতে তাকে। এক সময় পাঠক এবং প্রকাশকদের আবেদনের প্রেক্ষিতে ১৯৮৪ সালেই বইমেলার সময়কাল বাড়িয়ে পুরো মাস ব্যাপি করার সিদ্ধান্তও গ্রহণ করে বাংলা একাডেমি।

২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অমর একুশে বইমেলা থেকে বাসায় ফেরার পথে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সামনে সন্ত্রাসী হামলার শিকার হন ভাষাবিদ হুমায়ুন আজাদ। তার ওপর হামলার পর বিক্ষোভে ফেটে পড়েন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরা। গুরুতর আহত ড. হুমায়ুন আজাদ ২২ দিন সিএমএইচ হাসপাতালে এবং ৪৮ দিন ব্যাংককে চিকিৎসাধীন থেকে সুস্থ হয়ে দেশে ফিরেন। হুমায়ুন আজাদের উপর চরমপন্থী ইসলামী জঙ্গিরা এই হামলা চালিয়েছিল বলে পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে। ২০০৪ সালের ১২ আগস্ট ড. হুমায়ুন আজাদ জার্মানিতে মারা যান।
২০১৩ সালে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গনে বইয়ের স্টলগুলোতে দূবৃত্তরা আগুন ধরিয়ে দেয়।
২০১৪ সালে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’য় স্টলের সংখ্যা বাড়িয়ে বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ সোহরাওয়ার্দ্দী উদ্যানে স্থানান্তরিত করে।

বইমেলা চলাকালীন প্রতিদিন বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা সভা, কবিতা পাঠের আসর, লেখক আড্ডাসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক আয়োজ করে থাকে বাংলা একাডেমি। সন্ধ্যার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মনমুগ্ধকরতা শ্রোতাদেরকে মুহিতকরে। এছাড়া লেখককুঞ্জে লেখকদের সাথে পাঠকদের মন বিনিময়ের আয়োজনও করে থাকে বাংলা একাডেমি। পাঠকেরা লেখকদের বইয়ের ব্যপারে আলোচনা সমালোচনা করে থাকে এই লেখককুঞ্জে।
বইমেলার তথ্যকেন্দ্র থেকে প্রতিনিয়ত নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচনের খবর, প্রতিদিন প্রকাশিত বই, লেখক ও প্রকাশকের নাম প্রকাশ করা হয়। এছাড়া বিভিন্ন রেডিও ও টেলিভিশন চ্যানেল মেলার মিডিয়া স্পন্সর হয়ে মেলার তাৎক্ষণিক খবরাখবর দর্শক শ্রোতাদের অবহিত করে।

বাংলা একাডেমির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালে ৬৫ কোটি ৪০ লাখ টাকার বই বিক্রি হয়েছিল। যা ছিল তার আগের বছরের চেয়ে ২৩ কোটি টাকা বেশি। নতুন বই বই প্রকাশিত হয়েছে ৪ হাজার ৫৯১ টি। গত মেলায় নতুন বই প্রকাশ পেয়েছিল ৩ হাজার ৬৬৬টি।
বুধবার বাংলা একাডেমির পরিচালক ও অমর একুশে বইমেলা উদযাপন কমিটির সদস্য সচিব ড. জালাল আহমেদ গণমাধ্যমকে এ তথ্য জানান।

বই মেলায় রেকর্ড পরিমাণ টাকার বই বিক্রি হয়েছে। মাসব্যাপী অমর একুশে বইমেলায় ৭০ কোটি ৫০ লাখ টাকার বই বিক্রয় হয়েছে। যা গত বছরের চেয়ে ৫ কোটি টাকার বেশি।
ড. জালাল আহমেদ জানান, এবারের মেলায় গত মেলার চেয়েও মোট ৯৩৪টি বেশি বই প্রকাশ পেয়েছে। এই সংখ্যা আরও বেশি হবে। কারণ, অনেক প্রকাশনা সংস্থা তাদের নতুন বইয়ের তালিকা বারবার তাগিদ দেওয়ার পরও একাডেমির তথ্য কেন্দ্রে জমা দেয়নি। ফলে একাডেমির তথ্যকেন্দ্রে যে সব বইয়ের তালিকা জমা পড়েছে সেই তথ্যই আমরা মিডিয়াকে জানিয়ে দিচ্ছি।
নতুন বইয়ে রেকর্ড
বাংলা একাডেমির তথ্যকেন্দ্র থেকে জানা যায়, এবার বইমেলায় প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা চার হাজার ৫৯১টি। যা গতবারের চেয়ে ৯৪৫টি বেশি। গতবার বই প্রকাশিত হয়েছিল ৩ হাজার ৬৬৬টি।
এবার নতুন বইয়ের মধ্যে কবিতার বইয়ের সংখ্যা বেশি ১ হাজার ৪৭২টি। এরপর রয়েছে গল্প ও উপন্যাসের স্থান। এবার গল্পের বই ৭০১টি এবং ৬৪৩টি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে।
মননশীল বইয়ের মধ্যে প্রবন্ধ ২৫৭টি, গবেষণা ১২২টি, জীবনীগ্রন্থ ১০৭টি, রচনাবলী ১৫টি, নাটক ২৩টি, ভ্রমণ বিষয়ক ৯১টি, ইতিহাসের ১১০টি বই প্রকাশিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বই প্রকাশিত হয়েছে ৯১টি।
এছাড়া নতুন বইয়ের মধ্যে বিজ্ঞান বিষয়ক ৭৬টি, রাজনীতি-২২টি, চিকিৎসা/স্বাস্থ্য- ৩৩টি, রম্য ও ধাঁধাঁ-২১টি, ধর্মীয়- ২৬টি এবং ৪৮টি অনুবাদ গন্থ প্রকাশিত হয়েছে। শিশুতোষ বই এসেছে ১২৫টি।
তরুণ পাঠকের আগ্রহের তুঙ্গে থাকা সায়েন্স ফিকশন ও গোয়েন্দা বিষয়ক বই এসেছে ৬৫টি। এছাড়া অভিধান বিষয়ক বই এসেছে ৭টি, অন্যান্য বিষয়ে এসেছে ৪২৪টি বই।
বই মেলার শেষ দিনে বিকেলে অনুষ্ঠিত হয় ‘বাংলাদেশের আদিবাসী ’ শীর্ষক সেমিনার। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন রাহমান নাসির উদ্দিন। সভাপতিত্ব করেন রাশিদ আসকারী। আলোচনায় অংশ নেন ফয়জুল লতিফ চৌধুরী ও রণজিত সিংহ।
সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। এতে সভাপতিত্ব করেন বাংলা একাডেমির সভাপতি ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। স্বাগত ভাষণ দেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক ড. শামসুজ্জামান খান। বক্তব্য রাখেন মেলা কমিটির সদস্য সচিব ড. জালাল আহমেদ।

২০১৯ সালে বই বিক্রিতে আবারও নয়া রেকর্ড গড়লো অমর একুশে গ্রন্থমেলা। মেলায় ১ মাস ২দিনে সর্বমোট ৪ হাজার ৮৩৪টি নতুন বই প্রকাশ পেলো। গত বছরের মেলায় মোট নতুন বই প্রকাশ পেয়েছিল ৪ হাজার ৫৯০টি। এ বছর নতুন বইয়ের সংখ্যা ২৪৪টি বৃদ্ধি পেয়েছে।
অন্যদিকে মেলায় এবার ১ মাস দুইদিনে ৮০ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছে। গত বছরের মেলায় বই বিক্রি হয়েছিল ৭০ কোটি ৫০ লাখ টাকার। গত বছরের মেলার চেয়ে এবার সাড়ে ৭ কোটি টাকা বিক্রি বেড়েছে। অমর একুশে গ্রন্থমেলা উদযাপন কমিটির সদস্য সচিব ও বাংলা একাডেমির পরিচালক ড. জালাল আহমেদ আজ বিকেলে এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, মেলা উপলক্ষে গঠিত নীতিমালা বাস্তবায়ন কমিটির সার্ভে টিম মেলার এইসব তথ্য সংগ্রহ করেছে।
গত মাসের পয়লা ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমিতে আনুষ্ঠানিকভাবে মেলার উদ্বোধন করেছিলেন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর পর থেকে পুরো ফেব্রুয়ারি মাসের ২৮ দিন মেলা চলে। তবে প্রকাশকদের দাবির প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মেলার সময় দুইদিন বাড়িয়ে ২ মার্চ পর্যন্ত বর্ধিত করেন। ফলে এক মাস দুই দিন এবারের মেলা চলে।
এবারের মেলায় বাংলা একাডেমির বই বিক্রি হয়েছে ২ কোটি ৩৪ লাখ টাকার। প্যাভিলিয়ন ছিল ২৪টি। একটি বাদে ২৩টি প্যাভিলিয়নে কোটি টাকার উপরে বই বিক্রি হয়েছে বলে ড. জালাল জানান। এ ছাড়া তিনটি প্যাভিলিয়নে দুই কোটি টাকার উপরে বিক্রি হয়েছে বলে জরিপকর্মীরা তথ্য দিয়েছেন। এবার মেলায় সর্বমোট ৭১৯টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের ৭৭০টি ইউনিট স্টল ছিল।
মেলায় প্রকাশিত নতুন বইয়ের ওপর এবার জরিপ করেছে মেলা কমিটির পক্ষ থেকে। কমিটি পক্ষে একাডেমির কাছে পেশ করা তথ্যে জানা যায়, এবার মেলায় ১১৫০টি মানসম্মত বই প্রকাশ পেয়েছে, যে বইগুলোকে জরিপকর্মীরা উন্নতমানের বলে অভিমত রেখেছেন।
ড. জালাল এবারের মেলা সম্পর্কে বলেন, এই মেলা ছিল অসাধারণ। মেলার মূল থিম ‘ বিজয় ১৯৫২ থেকে ১৯৭১ : নবপর্যায়’কে কেন্দ্র করে মেলা নান্দনিকতায় ছিল ভরপুর। স্টল, প্যাভিলিয়ন ও মেলার পরিবেশ ছিল অন্যান্য বারের চেয়ে নান্দনিক ও শোভিত। অন্যান্য সব ব্যবস্থা ছিল লক্ষ্যনীয়। নতুন নতুন আয়োজনও ছিল। সব মিলে এবারের মেলা সফলভাবে শেষ হলো বলে তিনি অভিমত রাখেন।
তিনি জানান, মেলায় এবার নিরাপত্তা কাজে বিভিন্ন বাহিনীর ১২ শত সদস্য নিয়োজিত ছিলেন। তারা অত্যন্ত দায়িত্বশীলতার পরিচয় রেখেছেন। সোহরাওয়াদী উদ্যানে মোড়ক উন্মোচন মঞ্চে এ মাস দুই দিনে ৮২৪টি নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়। এতে ৩ হাজারেরও বেশি লোক অংশ নেন। ৩০ দিনে ‘লেখক বলছি’ মঞ্চে ৩১০ জন প্রবীণ, নবীন, তরুণ লেখক, প্রকাশক ও সাহিত্যিক তারা তাদের নতুন বই নিয়ে পাঠকের মুখোমুখী হন।

বই বিক্রিতে আবারও নয়া রেকর্ড গড়লো অমর একুশে গ্রন্থমেলা। ২০২০ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় ৮২ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছে, জানিয়েছেন মেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব ড. জালাল আহমেদ। যা গতবারের তুলনায় দুই কোটি টাকা বেশি।
শনিবার (২৯ ফেব্রুয়ারি) অমর একুশে গ্রন্থমেলার সমাপনী অনুষ্ঠানে তিনি এ তথ্য জানান। এবারের মেলায় ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত স্টল মালিকদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য এবং গতকালের সম্ভাব্য বিক্রি যুক্ত করে এ হিসাব দেওয়া হয়েছে।

২০২১ সালে বইয়ের বিক্রি কমে মাত্র ৩ কোটি ১১ লাখ টাকায় নেমে আসে।
জালাল আহমেদ বলেন, 'মোট বিক্রির ধারণা পেতে বাংলা একাডেমি মেলার শেষের দিকে একটি জরিপ চালায়।' তিনি আরও জানান, যদিও আমরা পুরোপুরি সঠিক সংখ্যা পাইনি, তবুও অনুমান করে বলতে পারি, এ বছরের বিক্রি প্রত্যাশাকে ছাড়িয়ে গেছে।
'২০২২ সালের একুশে বইমেলায় ৩ হাজার ৪১৬টি নতুন বই প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে ২৬ শতাংশ বই বাংলা একাডেমির 'কোয়ালিটি পাবলিকেশন' হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। মেলায় বাংলা একাডেমি ১ কোটি ২৭ লাখ টাকার বই বিক্রি করেছে।'
এ বছর প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে রয়েছে ১ হাজার ৬০টি কবিতার বই, ৫০১ টি উপন্যাস এবং ৪৬৭টি গল্পের বই। প্রাথমিকভাবে ২৮ ফেব্রুয়ারি মেলা শেষ হওয়ার কথা ছিল। তবে আয়োজকরা মেলার সময়সীমা ১৭ মার্চ পর্যন্ত বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন।

গাইবান্ধার বিমল সরকার সাহিত্য সম্ভার ও পাঠাগারের প্রচার সম্পাদক ওয়াজেদ হোসেন জিম লিস্ট ধরে বই কিনছিলেন বইমেলায়। প্রায় ১ লাখ টাকার বই কিনলেন তিনি। জানালেন, ৯ থেকে ১১ মার্চ গাইবান্ধায় গ্লোবাল ভিলেজ বইমেলা হবে সেজন্যই বই কিনছি। গতকাল শেষ দিনে বই বিক্রির ধুম পড়েছিল বইমেলায়। মেলায় যারা এসেছেন তাদের অধিকাংশই বই কিনেছেন। লেখক-পাঠকের মিলনমেলা হয়ে উঠেছিল শেষ দিনের বইমেলা।
বাংলা একাডেমির হিসাবে বইমেলায় এবছর বিক্রি হয়েছে প্রায় ৪৭ কোটি টাকা। প্রকাশকরা বলছেন, গতবছর করোনার মধ্যেও বিক্রি এবারের তুলনায় বেশি ছিল। গত বছরের তুলনায় বিক্রি খুব একটা বাড়েনি। কোনো কোনো প্রকাশকের বিক্রি খুবই কম। যাদের বইয়ের আয়োজন বেশি ছিল তাদের বিক্রিও আশানরূপ নয়। বইমেলা নিয়ে লেখকরাও মিশ্র প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন। তাদের মত, বইমেলাকে ঢেলে সাজানোর সময় এসেছে। প্রকাশকবান্ধব মেলা করতে গিয়ে এত এত প্রকাশকদের স্থান দেওয়া হয়েছে যে, মৌসুমি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের ভিড়ে মানসম্পন্ন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। তাই, মেলায় ভুঁইফোড় প্রকাশনাগুলোকে স্থান না দিয়ে ভালো প্রকাশকদের নিয়েই বড় পরিসরে বইমেলা আয়োজন করার পক্ষে মত দিয়েছেন তারা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দেশের ঐতিহ্যবাহী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক জানালেন, বই বিক্রি কম। করোনার আগে যে পরিমাণ বিক্রি হয়েছিল এবার তার প্রায় অর্ধেক।
মেলায় এসেছিলেন কথাসাহিত্যিক, কবি আনিসুল হক। ছিলেন প্রথমা প্রকাশনের প্যাভিলিয়নে। তিনি বললেন, বইমেলা যে আশা জাগিয়ে শুরু হয়েছিল শেষ বেলায় এসে তা আর থাকেনি। বই বিক্রি আশানুরূপ হয়নি। তিনি বইমেলা স্টল বিন্যাসের জন্য স্থপতিদের পরামর্শ নেওয়ার কথা বলেন। পাশাপাশি বইমেলায় মৌসুমি প্রকাশকদের বাদ দিয়ে যারা ভালো ও মানসম্পন্ন বই প্রকাশ করে তাদের নিয়ে গোছানো মেলা করার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেন, বইমেলায় সরকারের কোনো অর্থসহায়তা দেওয়া হয় না বলে শুনেছি। এটা যদি সত্য হয়, তা খুবই দুঃখজনক। সরকারের এ খাতে বিনিয়োগ হওয়া উচিত। কারণ, জ্ঞানের ক্ষেত্রে শিক্ষার ক্ষেত্রে বিনিয়োগই শ্রেষ্ঠ বিনিয়োগ। আমরা যে আদর্শের কথা বলি, তা টাকা খরচ করে সমাবেশ করে মানুষকে বললে হবে না। বই পড়লেই মানুষকে সেই আদর্শে উদ্বুদ্ধ করা সম্ভব হবে। সুতরাং বইয়ের প্রসারে বিনিয়োগ করতে হবে।
এদিকে, ঐতিহ্য প্রকাশনীর ব্যবস্থাপক আমজাদ হোসনে কাজল জানালেন, কাগজের দাম বেশি হওয়ার পরেও মেলার বই বিক্রিকে খারাপ বলা যাবে না। অবসর প্রকাশনীর ব্যবস্থাপক মাসুদ রানা জানালেন, বই বিক্রি করোনাকালের আগের জায়গায় না পৌঁছালেও সন্তোষজনক। দেশ ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সার্বিক পরিস্থিতি বিচারে এর চেয়ে খারাপ বিক্রি হবে বলে মনে করেছিলাম, কিন্তু তা হয়নি। এদিকে, য়ারোয়া বুক কর্নারের প্রকাশক জিন্নাতুন নিসা বললেন, বইমেলায় ১ লাখ টাকাও বিক্রি হয়নি।
গতবছর মেলায় বিক্রি হয়েছিল ৫২ কোটি ৫০ লাখ টাকার বই। করোনাকালের মধ্যে ২০২১ সালে মেলায় বিক্রি হয়েছিল ৩ কোটি, ২০২০ সালে সাড়ে ৮২ কোটি, ২০১৯ সালে ৮০ কোটি, ২০১৮ সালের মেলায় বই বিক্রি হয়েছিল ৭০ কোটি টাকার। ২০১৭ সালে বিক্রি হয়েছিল ৬৫ কোটি ৪০ লাখ টাকা, ২০১৬ সালে ৪২ কোটি, ২০১৫ সালে বই বিক্রি হয়েছিল প্রায় ২২ কোটি টাকা।
গতকাল মেলার শেষ দিনে বই এসেছে ২৬৭টি। এবছর বইমেলায় নতুন বই এসেছে ৩ হাজার ৭৩০টি। তবে এ হিসাব বাংলা একাডেমির তথ্যকেন্দ্রে জমা পড়া বইয়ের। এর বাইরেও মেলায় নতুন বই প্রকাশ হয়েছে। এবছর, গতকাল মঙ্গলবার অমর একুশে গ্রন্থমেলার সমাপনী দিনে বাংলা একাডেমির জনসংযোগ উপবিভাগ থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, এ বছর সর্বোচ্চ বই প্রকাশিত হয়েছে কবিতার। যা সংখ্যার হিসেবে ১ হাজার ২৪৭টি। এ ছাড়া এ বছর গল্প ৪৬৬, উপন্যাস ৫০৩টি, প্রবন্ধ ১৯৭টি, গবেষণা ৭৫, ছড়া ৮১, শিশুতোষ ৭৯টি, জীবনী ১২৮, রচনাবলি ৪৩, মুক্তিযুদ্ধ ৮০, নাটক ৫৪, বিজ্ঞান ৫১, ভ্রমণ ৬৭, ইতিহাস ৮৭, রাজনীতি ৩৩, স্বাস্থ্য ৩৩, রম্য ২২, ধর্মীয় ৫৫, অনুবাদ ৬৯, অভিধান ১৩, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী ৬৭, বঙ্গবন্ধু বিষয়ক ৩৫ এবং বিবিধ বিষয়ে বই এসেছে ২৬৬টি।
বইমেলার সমাপনী অনুষ্ঠান : বিকালে বইমেলার মূলমঞ্চে আয়োজিত সমাপনী অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্য প্রদান করেন একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা। প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন বইমেলার সদস্য-সচিব ডা. কে এম মুজাহিদুল ইসলাম। প্রধান অতিথি ছিলেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন বাংলা একাডেমির সচিব এ এইচ এম লোকমান। সভাপতিত্ব করেন বাংলা একাডেমির সভাপতি কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন।
কে এম খালিদ এমপি বলেন, আনন্দ-উদ্দীপনার মধ্যদিয়ে উদযাপিত এবারের বইমেলা সমাপ্তির দ্বারপ্রান্তে। বইমেলা কেবল বই বিক্রির জায়গা নয়। দল, মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলের প্রাণের মেলা অমর একুশে বইমেলা ২০২৩ সকলের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও সহযোগিতায় সাফল্যমণ্ডিত হয়েছে।