আয়কর রিটার্ন ভুল হলে সমাধান আছে আইনেই
মোহাম্মদ সিরাজ উদ্দিন
আয়কর রিটার্ন দাখিল করাকে অনেকে ঝামেলার কাজ মনে করেন। এই ঝামেলা মনে করার কারণ নানাবিধ। কেউ মনে করেন তিনি আয় করেন, সরকারকে ট্যাক্স দিয়ে দেন, এটাই যথেষ্ট, আবার রিটার্ন দেবেন কেন? এটা কেউ বুঝে বলেন কিনা তাও বোঝা যায় না, কেউ একেবারেই না বুঝে বলেন, কেউ বা বলেন ধারণা থেকে। এই বলাবলির শেষ হয়তো হবে না, কিন্তু তার বা তাহাদের বা নাগরিকদের শেষ পরিণতি হলো আয়, ব্যয় ও সম্পত্তির হিসাব এনবিআর-এ জমা দিতে হয়। কারণ রীতিতে আছে, দুনিয়ার অন্যান্য দেশে আছে, আমাদের দেশে আইনেও আছে। নাগরিক হিসেবে আইন না মানলে আর্থিক দণ্ড হওয়ার যেমন ভয় আছে, তেমনি জেলও খাটার ভয় আছে।
এসব দলিলি, বেদলিলি আলোচনা যখন বাজারে চলমান থাকে, এর মাঝে আরেক দল নাগরিককে হা-হুতাশ করতে থাকে, তার রিটার্ন ভুল হয়ে গেছে! এখন কী করবেন? কর অফিসে গেলেই বুঝি একঝাঁক বকা আর কেরানির ঘুতঘুতানি শুনতে হবে। কেউ বা মনে মনে ধরেই নিয়েছে অফিসে গেলেই কেউ একজন টেবিলের নিচ দিয়ে হাত দিয়ে বলবেন কিছু দিয়ে দেন ঠিক করে দেবেন, বা কেউ হেসে বলবে চা খাবার পয়সা দেন ঠিক করে দিচ্ছি। কেউ বলবেন, “আরে আল্লাহ! আপনি বিশাল ভুল করেছেন! আপনার বড় অঙ্কের জরিমানা হবে!” এসব হতাশা ও মুখরোচক বা অপ্রিয় কথাগুলো করদাতা শুনেন প্রতিনিয়ত, এমনটা একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
আচ্ছা ধরে নিলাম আপনি আয়কর রিটার্ন নিজে নিজে করেন। আপনি একজন করদাতা যখন নিজেই রিটার্ন দাখিল করার উদ্যোগ নেবেন, বা নিয়েছেন, এই জন্য আপনাকে এই অধমের পক্ষ থেকে প্রথমেই আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। কারণ আপনি একজন গর্বিত করদাতাই শুধু নয়, আপনি একজন সচেতন নাগরিকও বটে। অধিকতর সচেতন মানুষেরাই নিজের কাজ নিজে করেন। এই জন্যে আপনি নিজের আয়-ব্যয় ও সম্পত্তির হিসাব সরকারকে দিতে উদ্যোগ নিয়েছেন বা নিজেই দিয়ে থাকেন। হ্যাঁ, সবাই সমানভাবে পারবেন এমনটা কখনও চিন্তা করা ঠিক না। ভুল হতেই পারে। ভুল যেখানে, সমাধানও সেখানে আছে।
একজন দাতা সাধারণত নিজে নিজে ফাইল করতে গিয়ে যে ভুলগুলো করে থাকেন: একাধিক খাতের আয় থাকলে সব খাতের আয় যথাযথভাবে উপস্থাপন করেন না, সম্পত্তির হিসাব সঠিকভাবে লিখেন না, কোন সম্পত্তি ক্রয় বা বিক্রি থাকলে তা সঠিকভাবে উপস্থাপন করেন না, বিগত বছরের জের টানতে ভুল করেন, বিগত বছরের নিট সম্পত্তি চলতি বছরে লেখতে ভুল করেন, আর্থিক পরিসম্পদ থেকে আয়গুলো যথাসময়ে হিসাবভুক্ত করেন না, পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রি করার অর্থ প্রদর্শন করেন না, আগের জমি বা প্লট বা ফ্ল্যাট বিক্রির অর্থ যথাযথভাবে উপস্থাপন করেন না বা কোনও নিকট আত্মীয় থেকে প্রাপ্ত দান প্রদর্শন করতে ভুলে যান ইত্যাদি। কিন্তু রিটার্ন জমা দেওয়ার পর তার কাছে মনে হলো তিনি এই ভুলগুলোর মধ্যে কোনও না কোনও ভুল করেছেন।
রিটার্ন নিজের কাছে ধরার সাথেই যে কাজটি করবেন: আপনার জমা দেওয়া রিটার্ন পরবর্তীতে ভুল হয়েছে এমন মনে হলে একজন নিয়মিত কর-আইনজীবীর সহায়তা নিতে পারেন বা আপনার চেয়েও ভালো জানেন এমন কোনও একজন সহকর্মী, বন্ধু বা পরিচিতজনকে অনুরোধ করতে পারেন, আপনি যা ভুল মনে করছেন, তা ভুল কিনা। যদি সত্যিই ভুল হয়েই থাকে, তাহলে কোনও রকম ভয়-ডর ছাড়াই আপনি সংশোধনী রিটার্ন দাখিল করতে পারেন। এই সংশোধনী রিটার্ন যেকোনও সময় দাখিল করা যায়। তবে আইনে আছে ৬ মাসের মধ্যে কোনও দরখাস্ত করতে হবে না। এই সময়ের মধ্যে আপনি যখনই মনে করবেন আপনার রিটার্ন ভুল হয়েছে, তখনই সংশোধনী রিটার্ন জমা দিবেন। ছয় মাস অতিবাহিত হলে আপনার সার্কেলের উপ-কর কমিশনার বরাবর একটা দরখাস্ত করে আপনি স্ব-উদ্যোগে সংশোধনী রিটার্ন দাখিল করতে পারবেন। এই জন্যে অহেতুক কোনও চিন্তা করা থেকে বিরত থাকলেই যথেষ্ট।
সংশোধনী রিটার্ন সম্পর্কে আইনে যে সমাধান আছে: আয়কর আইন ২০২৩ এর ১৭৫ ধারা মোতাবেক “সাধারণ রিটার্ন”-এর ক্ষেত্রে সংশোধনী রিটার্ন দাখিল করা যাবে। (১) ধারা ১৬৬ বা ২১২ অনুসারে “সাধারণ রিটার্ন” দাখিলের পর রিটার্নে কোনও উপেক্ষিত বা অশুদ্ধ বিবৃতি পরিলক্ষিত হলে, কোনও প্রকার করদায় হ্রাস না করে, সংশোধনী রিটার্ন দাখিল করা যাবে। যে ক্ষেত্রে কর নির্ধারণ সম্পন্ন হয়নি, সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট করবর্ষের কর নির্ধারণী আদেশে প্রণয়নের সর্বশেষ তারিখের অন্তত ৬ (ছয়) মাস পূর্বে অথবা প্রথমবার ধার্যকৃত শুনানির তারিখের পূর্বে, যা আগে ঘটবে, সংশোধনী রিটার্ন দাখিল করতে হবে। (২) রিটার্ন বা সংশোধনী রিটার্নটি অসম্পূর্ণ বলা হলে, উপ-কর কমিশনার, কারণ উল্লেখপূর্বক, করদাতার নিকট সংশ্লিষ্ট তথ্যাদি যাচাইকরণ, বিবৃতি বা দলিলাদি নোটিশে উল্লেখিত সময়ের মধ্যে দাখিল করার জন্য নোটিশ প্রদান করবেন। (৩) কোনও করদাতা উপ-ধারা (২)-এর অধীনে প্রদত্ত নোটিশ সম্পূর্ণরূপে অনুসরণ করতে ব্যর্থ হলে, রিটার্ন বা সংশোধনী রিটার্ন যা অসম্পূর্ণ বলা হয়েছিল তা বাতিল বা অবৈধভাবে বিবেচিত হবে।
এছাড়া সংশোধিত রিটার্ন দাখিলের ক্ষেত্রে “আয়কর আইন ২০২৩-এর ধারা ১৮০-এর উপ-ধারা ২ দফা-গ অনুযায়ী যদি আইনের অধীন প্রদেয় কর সঠিকভাবে পরিগণিত না হয় বা সঠিক পরিশোধিত না হয়, তাহলে করদাতা একটি লিখিত বিবৃতিতে কারণ উল্লেখপূর্বক সংশোধিত রিটার্ন দাখিল করতে পারবেন।”
করদাতাগণকে সতর্ক থাকতে হবে যেন আয়কর রিটার্নে ইচ্ছাকৃত কোনও ভুল তথ্য বা অতিরিক্ত কাগজপত্রাদি সংযুক্ত করা না হয়। এতে সংশ্লিষ্ট কর-কর্মকর্তারা অহেতুক বিবর্তন হন এবং করদাতাকে ভুল বুঝতে পারেন। সরল বিশ্বাসে ভুল হলে সংশোধন করা যায়। কিন্তু ইচ্ছাকৃত কোনও তথ্য গোপন করা বা ভুল তথ্য উপস্থাপন কাম্য নয়, বরং এতে আইনি জটিলতা বৃদ্ধি পায়। আসুন আইন জানি, সতর্ক থাকি এবং আইনি সুরক্ষার সুযোগগুলো গ্রহণ করি।
মোহাম্মদ সিরাজ উদ্দিন: আইনজীবী, ঢাকা।