মাইনক্রাফ্ট সর্বকালের অন্যতম জনপ্রিয় ভিডিও গেম। ২০০৯ সালে প্রথম বাজারে আসার পর, ২০২৩ সালের মধ্যে এর ৩০০ মিলিয়নেরও বেশি কপি বিক্রি হয়েছে। এটি এবং রোব্লক্স এবং টেরারিয়ার মতো গেমগুলি শিশু থেকে প্রাপ্তবয়স্ক পর্যন্ত সব বয়সের গেমাররা উপভোগ করে।
এই গেমটি ঘণ্টার পর ঘণ্টা শিশুদের মনোযোগ ধরে রাখতে সক্ষম, এখনকার স্বল্পস্থায়ী মনোযোগের যুগে এটি একটি অসাধারণ কৃতিত্ব। অবশ্য কিছু অভিভাবকের শঙ্কা রয়েছে যে মাইনক্রাফ্টের প্রতি তাদের সন্তানদের আগ্রহ প্রায় আসক্তির পর্যায়ে চলে যেতে পারে। কারণ তারা তাদের কম্পিউটার স্ক্রিন থেকে দূরে সরাতে হিমশিম খান।
মাইনক্রাফ্টের জনপ্রিয়তা এতটাই বেশি যে, জ্যাক ব্ল্যাক এবং জেসন মোমোয়া অভিনীত ‘আ মাইনক্রাফ্ট মুভি’ নামে একটি বহুল প্রতীক্ষিত হলিউড চলচ্চিত্র ২০২৫ সালের এপ্রিলে মুক্তি পেতে চলেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, মাইনক্রাফ্ট এবং এর মতো গেমগুলির সাফল্যের পিছনে গভীর মনস্তাত্ত্বিক- এমনকি বিবর্তনীয় কারণও থাকতে পারে। এই গেমগুলি আমাদের সকলের মধ্যে একটি সহজাত প্রবৃত্তিকে কাজে লাগায়- যা আমাদের সমগ্র প্রজাতির সাফল্যের ভিত্তি। আর সেটি হলো- নির্মাণের আকাঙ্ক্ষা।
শিশুরা সবসময়ই কিছু না কিছু তৈরি করতে পছন্দ করে- স্যান্ডক্যাসল, দুর্গ, ট্রিহাউস- এর কয়েকটি উদাহরণ মাত্র। কাঠের ব্লক, ক্লেডো এবং লেগোও ভাল উদাহরণ। মাইনক্রাফ্ট সম্ভবত ডিজিটাল জগতে এই ধরনের খেলার একটি সাম্প্রতিক সংস্করণ। অনেক শিশুর কাছেই এই বিভিন্ন ধরনের বস্তু তৈরির বিষয়টি আকর্ষণীয় কেন?
যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটসের বোস্টন কলেজের শিশু শিক্ষার পদ্ধতি নিয়ে গবেষণারত মনোবিজ্ঞানী পিটার গ্রে বলেন, ‘সকল স্তন্যপায়ী প্রাণীই তাদের শৈশবে খেলাধুলা করে। উদাহরণস্বরূপ, শিকারি প্রাণীরা বিভিন্ন প্রাণী বা বস্তু ধরার খেলা খেলে। লাফানো এবং পালানোর অনুশীলন করে।
এ বছরই জনপ্রিয় এই গেমটির থিম নিয়ে একটি সিনেমা মুক্তি পাবে।
গ্রে বলেন, “তাদের বেঁচে থাকার এবং শেষ পর্যন্ত সঙ্গীর সাথে মিলিত হওয়ার ক্ষমতার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতাগুলো তারা খেলার মাধ্যমে আয়ত্ত করে”
মানুষ অন্যান্য প্রাণীদের থেকে আলাদা, কারণ আমাদের বেঁচে থাকার অনেকটাই নির্ভর করে বস্তু তৈরির ক্ষমতার ওপর- কাদা দিয়ে তৈরি কুঁড়েঘর থেকে শুরু করে শিকার এবং সংগ্রহের সরঞ্জাম পর্যন্ত। “এটা আশ্চর্যজনক নয় যে প্রাকৃতিক নির্বাচন শিশুদের জিনিস তৈরির খেলায় শক্তিশালী প্রেরণা দিয়েছে,” বলেন গ্রে।
শিশুরা কথা বলা ও কল্পনাশক্তি ব্যবহার করে খেলাধুলা করে, অথবা এমন সব খেলা তৈরি করে যেখানে নিয়মকানুন থাকে এবং একে অপরের সাথে মেলামেশা করার সুযোগ থাকে। এগুলো তাদের ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতি হিসেবে কাজ করে। তাদের হৃদয়ে থাকে – সবই যেন প্রাপ্তবয়স্ক জীবনের প্রস্তুতির অংশ।
গ্রে বলেন, খেলার সময় শিশুরা কী তৈরি করতে পছন্দ করে এবং কীভাবে তৈরি করে, তা সাধারণত তারা যে সংস্কৃতিতে বাস করে তার প্রতিফলন। তিনি বলেন, “আজ শিশুরা কম্পিউটারে খেলতে সত্যিই আকৃষ্ট হচ্ছে দেখে আমাদের মোটেই অবাক হওয়া উচিত নয় – এবং এটি আমাদের উদ্বিগ্নও করা উচিত নয়। আমি বলবো, শিশুরা তাদের হাড়ে, তাদের সহজাত প্রবৃত্তিতে জানে যে এই দক্ষতাগুলো তাদের বিকাশ করা দরকার।”
নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞানী জুলিয়ান টোগেলিয়াস তার নিজের ছেলের মধ্যেও বিভিন্ন জিনিস তৈরির সহজাত প্রবণতা লক্ষ্য করেছেন, যদিও তার বয়স এখনও তিন বছর হয়নি। টোগেলিয়াস ব্যাখ্যা করেন, নার্সারিতে তার ছেলে খেলনা ট্রেন এবং ট্রাক চালানোর জন্য সুড়ঙ্গ তৈরি করতে শুরু করে। যখন তার ছেলে একটু বড় হবে, তখন কম্পিউটারও তার কাছে প্রিয় বস্তু হয়ে দাঁড়াতে পারে। টোগেলিয়াস বলেন, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, স্যান্ডবক্স গেমগুলো (যেমন মাইনক্রাফ্ট, যেখানে খেলোয়াড়দের কোনো নির্দিষ্ট লক্ষ্য ছাড়াই তাদের সৃজনশীলতা অন্বেষণ করার স্বাধীনতা দেওয়া হয়) কম্পিউটারে কাজ করা এবং বিভিন্ন কিছু করা সহজ করে তোলে।
তিনি বলেন, “মাইনক্রাফ্টের জগতে সরাসরি এবং সহজভাবে কিছু তৈরি করা যায় । কোড লেখার চেয়ে এটি অনেক সহজ।”
অন্য কথায়, আগেকার দিনে কম্পিউটার শিশুদের নির্মাণের স্বাভাবিক ইচ্ছাকে বাধা দিত। কিন্তু এখনকার এই গেমগুলো সেই ইচ্ছাকে পূরণ করে।
শুধু যে জিনিস তৈরি করা যায়, তা-ই নয়, আরও অনেক কারণে মাইনক্রাফ্ট গেমটি আকর্ষণীয়। গেমের স্যান্ডবক্স মোডে খেলোয়াড়রা নিজেদের ইচ্ছেমতো জিনিস তৈরি করতে পারে। তবে, এখানে সার্ভাইভাল মোডও আছে, যেখানে শত্রুদের সাথে লড়াই করতে হয়। মিনোট্টি বলেন, এছাড়া এই গেমটি খেলার মাধ্যমে সামাজিক সম্পর্কও তৈরি হয়।
যখন তার বাচ্চারা তাদের বন্ধু বা চাচাতো-মামাতো ভাইদের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে দেখা করতে পারে না, তখন তারা অনলাইনে দেখা করতে পারে: “এটি একটি ভার্চুয়াল আড্ডার জায়গা হয়ে ওঠে।”
মাইনক্রাফ্টকে একটি ভার্চুয়াল খেলার মাঠ হিসেবে ভাবা যেতে পারে, যেখানে শিশুরা তাদের নিজস্ব স্থান খুঁজে নিতে পারে। কারণ এই গেমে বিভিন্ন ধরনের কার্যকলাপ এবং খেলার শৈলী বাছাই করার সুযোগ তাদের রয়েছে।
টোগেলিয়াস গবেষণা করেছেন- কীভাবে মাইনক্রাফ্টে গেমারদের আচরণ তাদের ব্যক্তিত্বের দিকগুলো প্রকাশ করে।
তিনি মনে করেন, মাইনক্রাফ্ট গেমে খেলোয়াড়দের নিজেদের মতো করে খেলার স্বাধীনতা দেওয়া হয়। ফলে, আর্কেড ক্লাসিক ‘অ্যাস্টেরয়েডস’ গেমের চেয়ে এই গেমে খেলোয়াড়রা নিজেদের ব্যক্তিত্ব ভালোভাবে প্রকাশ করতে পারে। ‘অ্যাস্টেরয়েডস’ গেমে খেলোয়াড়দের মহাকাশ থেকে আসা পাথরগুলোতে গুলি করতে হয়, যেখানে নিজেদের মতো করে কিছু করার সুযোগ খুব কম।
টোগেলিয়াস তার গবেষণার জন্য প্রাপ্তবয়স্কদের একটি প্রশ্নপত্র পূরণ করতে বলেন। এই প্রশ্নপত্র থেকে তাদের ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে কিছু ধারণা পাওয়া যায়। এরপর, তিনি প্রশ্নপত্রের উত্তরের সঙ্গে মাইনক্রাফ্ট খেলার ধরন তুলনা করেন। গবেষণায় দেখা যায়, মাইনক্রাফ্টে খেলার ধরনের ওপর উত্তরদাতাদের ব্যক্তিত্বের কিছু বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে মিল রয়েছে।
যদিও টোগেলিয়াস শিশুদের নিয়ে গবেষণা করেননি, তার ধারণা, বড়দের মতো শিশুদের ব্যক্তিত্বও গেমে প্রকাশ পায়। তার গবেষণায় তিনি দেখেছেন, মাইনক্রাফ্ট খেলোয়াড়রা সাধারণ মানুষের চেয়ে বেশি কৌতূহলী এবং তাদের মধ্যে প্রতিশোধ নেওয়ার প্রবণতা কম। অর্থাৎ, তারা নতুন জিনিস জানতে চায় এবং অন্যের ক্ষতি করার চেয়ে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণে বেশি আগ্রহী
টেক্সাস টেক ইউনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞানী বেইলি ব্রাশিয়ার্স, যিনি মাইনক্রাফ্টকে মনস্তাত্ত্বিক গবেষণার কাজে কীভাবে ব্যবহার করা যায়, তা নিয়ে একটি গবেষণা পত্র প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, স্যান্ডবক্স গেমগুলোর (যেমন: মাইনক্রাফট) বিস্তৃত সুযোগের কারণে এটি অনেকের কাছেই জনপ্রিয়। ব্রাশিয়ার্স গেমটির পাঁচটি প্রধান দিক চিহ্নিত করেছেন:
১. সামাজিক দিক ( যেমন: অন্যদের নিয়ে একসাথে খেলা)
২. নিজের দক্ষতা প্রমাণের সুযোগ ( যেমন: যুদ্ধ বা অনুসন্ধান)
৩. প্রকৌশল ( যেমন: বিভিন্ন জিনিস তৈরি করা)
৪. সৃজনশীলতা ( যেমন: নতুন কিছু বানানো)
৫. টিকে থাকার চেষ্টা ( যেমন: বিপদ থেকে বাঁচা)
ব্রাশিয়ার্স বলেন, “সাধারণত একটি গেমে এই দিকগুলোর মধ্যে এক বা দুটি থাকে। যেমন, ফোর্টনাইট গেমটি মূলত সামাজিক খেলা এবং টিকে থাকার চেষ্টার উপর ভিত্তি করে তৈরি।”
শিশুরা মাইনক্রাফ্টে অনেক বেশি সময় কাটায়, যা তাদের অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইম অভিভাবকদের উদ্বেগের কারণ। মেলিসা হোগেনবুমের একটি লেখায় স্ক্রিন টাইমের ভালো-মন্দ দিকগুলো আলোচনা করা হয়েছে।
মিনোট্টি বলেন, তার বাচ্চারা শুধু মাইনক্রাফ্ট খেলে না, তারা বাইরে বাস্কেটবলও খেলে। তবে, তিনি তাদের অতিরিক্ত ভিডিও গেম খেলা থেকে বিরত রাখেন এবং তাদের অনলাইন বন্ধুত্বের অনুরোধগুলো যাচাই করেন। তিনি বলেন, “আমরা তাদের ইন্টারনেটে অবাধে ছেড়ে দিই না।”
যুক্তরাজ্যের শিশুদের দাতব্য সংস্থা এনএসপিসিপি মাইনক্রাফ্ট খেলার সময় শিশুদের নিরাপত্তার জন্য কিছু পরামর্শ দিয়েছে। মাইনক্রাফ্টে শিশুদের ওপর নির্যাতন ও অপব্যবহারের মতো ঘটনা ঘটেছে। রোব্লক্সের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা অভিভাবকদের তাদের সন্তানদের গেম প্ল্যাটফর্ম থেকে দূরে রাখতে বলেছেন। যদি তারা ক্ষতিকর কিছু দেখার ভয়ে থাকেন।
মিনোট্টি মনে করেন তার বাচ্চারা নিরাপদে মাইনক্রাফ্ট খেলতে পারে। কারণ তিনি তাদের ওপর নজর রাখেন। তিনি বলেন, এটি একটি ডিজিটাল খেলার মাঠের মতো। মাইনক্রাফ্টের মাধ্যমে মানুষ নতুন উপায়ে যোগাযোগ করতে পারে। কোভিড-১৯ এর সময় অধ্যাপকরা মাইনক্রাফ্টের মাধ্যমে অনলাইনে পড়িয়েছেন। আয়ারল্যান্ডের শিক্ষকরা মাইনক্রাফ্ট এডুকেশনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের পড়াচ্ছেন।
শিক্ষার্থীদের গ্যেলিক ভাষা শেখার জন্য মাইনক্রাফ্টে একটি গেম তৈরি করা হয়েছিল। সেখানে রেস্টুরেন্ট ও খাবার তৈরি করে ভাষা শেখানো হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, মাইনক্রাফ্ট শিক্ষার্থীদের স্কুলের কাজে আগ্রহ বাড়ায়। মাইনক্রাফ্ট খেললে খেলোয়াড়রা গভীরভাবে মনোযোগী হয়। এটি তাদের মনোযোগ বাড়াতে সাহায্য করে।
তবে, মাইনক্রাফ্ট সবার কাছে সমান জনপ্রিয় নয়। অস্ট্রেলিয়ায় একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, মেয়েদের তুলনায় ছেলেরা বেশি মাইনক্রাফ্ট খেলে। লেখকরা বলেন, ছেলে ও মেয়ে উভয়ের জন্য গেমগুলো আকর্ষণীয় হওয়া উচিত। কারণ, গেমগুলো শিশুদের ডিজিটাল দক্ষতা বাড়াতে সাহায্য করে।
মিনোট্টি তার মেয়েদের কম্পিউটার দক্ষতা নিয়ে চিন্তিত নন। মাইনক্রাফ্ট তাদের পছন্দের খেলা। তাদের লেগো দিয়ে খেলার জায়গা নেই। তাই তারা মাইনক্রাফ্টে খেলে। তিনি বলেন, মাইনক্রাফ্টে তারা তাদের কল্পনার সব লেগো ব্লক ব্যবহার করতে পারে।