এযেন অর্থ লুটের নতুন কৌশল, সম্মিলিতভাবে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ লুটপাট। নাটোর পৌরসভার সদ্য সাবেক ১২ কাউন্সিল এবং একজন ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি একজোট হয়ে নিজেদের পকেটে ভরেছে প্রায় দেড় কোটি টাকা। পৌরসভার সদ্য সাবেক মেয়রের মৌখিক নির্দেশে মাদ্রাসা কাঁচা বাজারে ১৪টি দোকান বরাদ্দের নামে এই অর্থ লুটপাট হয়েছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। এই অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন পৌর নির্বাহী কর্মকর্তা।
নাটোর পৌরসভার ২ নং ওয়ার্ডের মাদ্রাসা কাঁচা বাজারে, সরকারি জমিতে দোকান নির্মাণ করে ব্যসায়ীদের কাছে ভাড়া দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন সদ্য সাবেক পৌর মেয়র উমা চৌধুরী জলি। মাদ্রাসা বাজারের পাশে পানির ট্যাংকির পূর্বে, উত্তর পটুয়াপাড়া পরিত্যক্ত বাসস্ট্যান্ডের জায়গায়, টেন্ডার ছাড়াই গত বছর ১ তলা বিশিষ্ট ১৪ টি দোকান ঘর নির্মাণ করা হয়। পৌর কর্তৃপক্ষের মৌখিক নির্দেশে নাটোর পৌরসভার ২ নং ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর মো. জাহিদুর রহমান জাহিদের তত্ত্বাবধানে বাজারের পাশে ১০ ফুট লম্বা ১২ ফিট চওড়া ১২টি এবং ৮ ফিট লম্বা ও ১০ ফিট চওড়া দুইটি সর্বমোট ১৪টি দোকান ঘর তৈরি করা হয়। ১২ কাউন্সিল ছাড়াও এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ৪ নং পৌর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বেসরকারি এক ক্লিনিকের মালিক আব্দুল আউয়াল রাজা। কাউন্সিলর না হয়েও রাজার নামে ফাঁকা জায়গা মৌখিকভাবে বরাদ্দ দেওয়া হয়।
মাদ্রাসা কাঁচা বাজারে ১৪টি দোকানের মধ্যে ১১টি বরাদ্দ পান ১১ জন কাউন্সিলর। আর ২ নং ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর মো. জাহিদুর রহমান জাহিদ দুটি দোকান এবং ৪ নং পৌর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল আউয়াল রাজা একটি দোকান বরাদ্দ পান। তড়িঘড়ি করে দোকান নির্মাণের পর বিভিন্ন ব্যবসায়ীদের কাছে পজিশন বিক্রি করে দেয়া হয়।
পৌরসভার হিসাব শাখা বলছে, জায়গা বরাদ্দ বাবদ পৌরসভায় ১২ টি দোকানের জন্য ৬১ হাজার ৫ শত টাকা এবং ২টি দোকানের জন্য ৪৮ হাজার টাকা পৌরসভায় জমা হয়েছে। এছাড়া প্রতিটির দোকান ঘরে প্রতি মাসে ভাড়া বাবদ ৬ শত টাকা করে রাজস্ব আয় হয় পৌরসভার। অর্থাৎ একটি দোকান বাবদ পৌর কর্তৃপক্ষ পেয়েছে ৪৮ থেকে ৬১ হাজার টাকা পর্যন্ত। কিন্তু এসব দোকানের ব্যবসায়ীরা বলছেন, প্রতিটির দোকান নেয়ার জন্য তারা ১৫ থেকে ১৭ লাখ টাকা করে দিয়েছেন।
পৌরসভার হিসাব অনুযায়ী, জায়গা বরাদ্দ বাবদ পৌরসভার কোষাগারে জমা হয়েছে ৭ লক্ষ ৩৮ হাজার টাকা। একটি দোকানের জায়গা ১০ লক্ষ থেকে ১৭ লাখ টাকা বিক্রি হয়েছে। গড়ে ১০ লাখ টাকা ধরা হলেও ১৪টি দোকান থেকে এক কোটি ৪০ লাখ টাকা লুটপাট করা হয়েছে।
মাদ্রাসা বাজারের স্থানীয় দোকানদার ভুট্টু সাহা কে বলেন, “মাদ্রাসা বাজারের পাশে গত বছর ১৪ টি দোকান ঘর নির্মাণ করা হয়। এক একটি দোকান ঘর বিক্রি করা হয়েছে ১৫ থেকে ২০ লক্ষ টাকা। কিন্তু পৌরসভায় কাগজে-কলমে পজিশন বিক্রির মূল্য সর্বোচ্চ ৬০ হাজার টাকা দেখানো হয়েছে। এই মার্কেট নির্মাণ করে লুট করা হয়েছে কোটি টাকা।’’
বারনইকে দেওয়া দোকান মালিক রাজু‘র বক্তব্যে জানা যায়, নাটোর পৌরসভা থেকে পজিশন ক্রয় করা তৃতীয় পক্ষ তিনি। প্রথম পক্ষ পৌরসভা। দ্বিতীয় পক্ষ ৪ নং পৌর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং সততা ক্লিনিক এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারের স্বত্বাধিকারী আব্দুল আউয়াল রাজা। দোকান মালিক রাজু বলেন, “রাজা ভাইয়ের নিকট থেকে ১৭ লক্ষ টাকা দিয়ে পজিশন ক্রয় করেছি। এই দোকানের ভাড়া পৌরসভায় দিতে হয় প্রতি মাসে ৬ শত টাকা।"
দোকান মালিক মানিক সাহা বলেন, “নাটোর পৌরসভার ২ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর জাহিদুর রহমান জাহিদের মাধ্যমে পৌরসভায় ১০ লাখ টাকা দিয়ে পজিশন কিনেছি। ভাড়া বাবদ প্রতি মাসে ৬ শত টাকা পৌরসভায় দিতে হয়। এই মার্কেটের সব দোকান নাটোর পৌরসভার কাউন্সিলরদের নামে হয়েছে বলে শুনেছি আর সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন ২ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর জাহিদুর রহমান জাহিদ। মানিক সাহা ১০ লক্ষ টাকা দিলেও পৌরসভা পেয়েছে ৬২ হাজার টাকা। এ বিষয়ে কিছুই বলতে পারেননি মানিক সাহা।
দোকান মালিক দুলাল হোসেন বলেন “দোকানঘরটি ১ বছর আগে পৌরসভা থেকে ১৮ লক্ষ টাকা দিয়ে ক্রয় করা হয়েছে। আর প্রতি মাসে ভাড়া দিতে হয় ৬ শত টাকা। আমি দোকানটি এক ব্যবসায়ীর কাছে মাসে ৬ হাজার টাকায় ভাড়া দিয়েছি।"
দোকান মালিক হনু সাহা বলেন, “৩ বছর আগে পৌরসভার কাছ থেকে পজিশন ক্রয় করেছিলাম। যাতে ভ্যাট ট্যাক্স দিয়ে ৬২ হাজার টাকা খরচ পড়েছিল, আর চা নাস্তা করার জন্য পৌরসভায় কিছু দিতে হয়েছে। নিজ খরচে দোকান ঘর নির্মাণ করি এক বছর আগে। তিন বছর থেকেই পৌরসভায় প্রতি মাসে ৬ শত টাকা জায়গার ভাড়া দিচ্ছি।" যদি ৬২ হাজার টাকায় দোকান ক্রয় করা হয়ে থাকে, তাহলে বাকি টাকা কোথায় গেল? চা নাস্তা করার জন্য কত টাকা দেওয়া হয়েছিল? এমন প্রশ্নের কোন সঠিক উত্তর দিতে পারিনি কোন দোকান মালিকরা।
নাটোর পৌরসভার হিসাবরক্ষক কর্মকর্তা মো. মির্জা সালাহ উদ্দিনবারনইকে জানান, “মাদ্রাসা বাজারের পাশে ১০ ফিট ১২ ফিট মাপে মোট ১২টি এবং ৮ ফিট ১০ ফিট মাপে ২টি মোট ১৪ টি রুমের জায়গা মৌখিকভাবে বরাদ্দ দেওয়া হয় নাটোর পৌরসভার ১২ জন কাউন্সিলরদের নামে। এছাড়া আব্দুল আউয়াল রাজা নামে একজনকে জায়গা বরাদ্দ দেওয়া হয়। তারা নিজেরাই দোকানঘর নির্মাণ করে নিয়েছেন। জায়গা বরাদ্দ বাবদ পৌরসভায় ১২ টি জায়গার জন্য ৬১ হাজার ৫ শত টাকা এবং ২টি জায়গার জন্য ৪৮ হাজার টাকা নেওয়া হয়েছে। প্রতিটির দোকান ঘরে প্রতি মাসে ভাড়া বাবদ ৬ শত টাকা করে রাজস্ব আয় হয় পৌরসভার।"
এ বিষয়ে বক্তব্য নিতে ৪ নং ওয়ার্ড পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল আউয়াল রাজার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে গেলে তাকে পাওয়া যায়নি। তার ব্যবহৃত মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে জানানো হয়, “ওমরা হজ পালনে জন্য সৌদি আরবে গিয়েছেন।"
পৌরসভার ২ নং ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর মো. জাহিদুর রহমান জাহিদের তত্ত্বাবধানে ১৪টি দোকান নির্মাণ ও বিক্রি হয়েছে। ব্যবসায়ীদের কাছে কেন লক্ষ লক্ষ টাকা নিয়ে পৌরসভায় জমা দেয়া হলোনা এবিষয়ে জানতে বার বার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়। একাধিকবার তার বাড়িতে গিয়েও তার খোঁজ পাওয়া যায়নি। বন্ধু পাওয়া যায় জাহিদের মুঠোফোন।
সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) নাটোর শাখার সভাপতি রেজাউল করিম রেজা বলেন, “দোকান মালিকরা যে টাকা দিলেন তার সামান্য জমা হলো পৌরসভায় আর লাখ লাখ টাকা কোনো হিসেব নেই। এটা অনিয়ম এবং দুর্নীতিও বটে। পৌরসভার ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের দুর্নীতির কারণে উন্নয়ন উন্নয়ন বঞ্চিত হয়েছে পৌরবাসী। এই অনিয়ম এবং দুর্নীতি কারীদের বিরুদ্ধে, আইনগত ব্যবস্থা না নেওয়া উচিত বলে, আমি মনে করি।"
সাবেক পৌর কাউন্সিলদের অর্থ লুটপাটের বিষয়ে নাটোর পৌরসভার পৌর নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রবিউল হক বলেন, “মাদ্রাসা বাজারে নতুন করে নির্মিত ১৪ টি দোকান ঘর বরাদ্দ, অথবা জায়গা বরাদ্দের বিষয়ে, আমি কিছু জানি না। এ বিষয়টা ভালো জানেন সাবেক মেয়র ও কাউন্সিলররা। তবে যদি কোন অনিয়ম বা দুর্নীতি হয়ে থাকে তাহলে, তদন্ত সাপেক্ষে অনিয়মকারীদের বিরুদ্ধে, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।"