নাটোরের বাহাদুর শাহ্ পার্ক নষ্ট করে মার্কেট বানালো পৌরসভা। সেই মার্কটের নির্মাণ কাজ পেলেন ছোট ভাই। আর মার্কেটের ২১ দোকানের মধ্যে ৯টি বরাদ্দ পেলেন ছোট ভাই। অন্য দোকানগুলো গোপনে ঘনিষ্ঠদের মধ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়। একটি ছোট মার্কেট নির্মাণ ও বরাদ্দ নিয়ে পৌরসভা কর্তৃপক্ষ যে নয়ছয় করেছে তাহলে বড় বড় কাজে কী হতে পারে? এমন প্রশ্ন তুলেছেন পৌরবাসীরা। এতোদিন সবাই মুখ বুজে সহ্য করলেও রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর কথা বলছেন অনেকে। প্রতিটি অনিয়ম-দুর্নীতির তদন্ত করে দোষীদের শাস্তির দাবি জানিয়েছেন তারা।
নাটোর পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আব্দুল মালেক বরনইকে বলেন, “বাহাদুর শাহ পার্ক মার্কেট নির্মাণের কাজ পায় এম এন ট্রেড প্রতিষ্ঠান। নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছিল প্রায় ৯২ লক্ষ টাকা। ভ্যাট এবং ট্যাক্স বাবদ বাদ যায় ১০ লক্ষ টাকা। এম এন ট্রেড কাজটি বিক্রি করে দেয় অনিমা জুয়েলার্সের মালিক নিরেন্দ্রনাথ কর্মকারের কাছে।’ তিনিই মার্কেটটি নির্মাণ করেন।
মার্কেট নির্মাণ থেকে শুরু করে বরাদ্দ দেওয়ার পর্যন্ত কোন স্বচ্ছতাই ছিল না। এই সমস্ত দোকান ঘর দরপত্র আহ্বান না করে গোপনে মেয়রের ঘনিষ্টদের মধ্যে দোকান বরাদ্দ দেওয়া হয়। উমা চৌধুরী জলি নিজেই স্বজনের নামে দোকান ঘর বরাদ্দ নিয়ে দ্বিগুণ দামে বিক্রি করেছেন। এছাড়াও প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা বেশিরভাগ দোকান বরাদ্দ নিয়েছিল।
নাটোর পৌরসভার হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মো. মির্জা সালাহ্ উদ্দিন বারনইকে জানান, “নাটোর পৌরসভার পিলখানায় অবস্থিত বাহাদুর শাহ পার্ক মার্কেটে মোট দোকান ঘর রয়েছে ২১ টি। এর মধ্যে নিপেন্দ্রনাথ কর্মকারের নামে বরাদ্দ দেওয়া হয় ৯টি দোকান। নিপেন্দ্রনাথ কর্মকার হলেন মার্কেট নির্মাণকারী ঠিকাদার নিরেন্দ্রনাথ কর্মকারের বড় ভাই।
এছাড়া মধু পোদ্দারের নামে ৪টি, স্বপন কুমারের নামে ১টি, কবি রানী দাসের নামে ১টি, সঞ্জীব কুমারের নামে ১টি, বিনয় কুমারের নামে ৩টি, আব্দুল আল মামুনের নামে ১টি এবং আব্দুস সালামের নামে একটি ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়। বর্তমানে বিনয় কুমারের নামে যে দোকানটি রয়েছে সেটির বরাদ্দ পেয়েছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ন সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মালেক শেখ। পরবর্তীতে ওই দোকানটি বিনয় কুমারের কাছে বিক্রি করে দেন মালেক শেখ।
নাটোর পৌরসভার হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মো. মির্জা সালাহ্ উদ্দিন জানান, এসব দোকান বরাদ্দ বাবদ সর্বনিম্নে ২ লক্ষ ৭০ হাজার টাকা, আর সর্বোচ্চ ১৫ লাখ টাকা জামানত রয়েছে। মোট জামানতের পরিমাণ ১ কোটি ৩৬ লক্ষ ৯০ হাজার টাকা।
বাহাদুর শাহ পার্কের নতুন নির্মিত তিন তলা মার্কেটের প্রায় মাঝখানে রয়েছে সিঁড়ি। সিঁড়ির পূর্বপাশে রয়েছে নয়টি দোকান ঘর এবং পশ্চিম পাশে রয়েছে মোট ১২টি দোকান। রাস্তা সংলগ্ন মার্কেটে পশ্চিম পাশের নিচ থেকে তিন তলা পর্যন্ত এই ৯টি দোকান বরাদ্দ দেওয়া হয় অনিমা জুয়েলার্স এর মালিক নিপেন্দ্রনাথ কর্মকারের নামে।
রাস্তা সংলগ্ন মার্কেটের প্রথম দোকানটি গুরুদেব জুয়েলার্স। এই দোকান মালিক বলরাম সরকার বারনইকে জানান, "অনিমা জুয়েলার্স এর কাছ থেকে দোকানটি ভাড়া নেওয়া হয়েছে এ দোকানের মাসিক ভাড়া ১৫ হাজার টাকা। দ্বিতীয় দোকান সরকার জুয়েলার্স এই দোকানের ভাড়া মাসে ২০ হাজার টাকা।"
সততা জুয়েলার্সের মালিক হাসান শেখ বারনইকে জানান, “অনিমা জুয়েলার্স এর নিকট থেকে দোকান ঘরটি ভাঙা নেওয়া হয়েছে জামানত হিসেবে কোন অর্থ জমা দেওয়া নেই তবে দোকান ঘরের ভাঙা দিতে হয় প্রতি মাসে ২০ হাজার টাকা।’’
সিঁড়ির ঘরের পশ্চিম পাশের প্রথম দোকানটি একটি কারখানা। এর মালিক সুজন কুমার সরকার বারনইকে বলেন, “মধু পোদ্দার এর নিকট হতে দোকানটি ভাড়া নিয়েছি। প্রতি মাসে ১৫ হাজার টাকা ভাড়া দিতে হয়।’’
নিউ আয়েশা জুয়েলার্স‘এর স্বত্বাধিকারী মো. লিটন খাঁ বারনইকে জানান, “সাগর জুয়েলার্স এর মালিকের নিকট থেকে এই দোকান ঘরটি ভাড়া নেওয়া হয়েছে জামানতবিহীন। প্রতি মাসে ১৫ হাজার টাকা ভাড়া। এছাড়াও এই মার্কেটের নিচ তলার পপুলার ট্যুরস এন্ড ট্রাভেলস, পার্বতী জুয়েলার্স, বি কে জুয়েলার্স‘এর দোকানগুলোর ভাড়া প্রতি মাসে ১৫ হাজার টাকা করে দিতে হয়।’’
মার্কেটের দ্বিতীয় তলার পশ্চিম পাশে একটি কারখানার মালিক ও বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতি নাটোর জেলা শাখার সাবেক সাধারণ সম্পাদক ভবেশ চন্দ্র চক্রবর্তী ভক্তের সাথে কথা হয়। তিনি বারনইকে বলেন, “আমার এই কারখানার দোকানটি সাবেক মেয়র উমা চৌধুরী জলির মেয়ের নামে। প্রতি মাসে ৮ হাজার টাকা ভাড়া দিতে হয়। তবে ভাড়া টাকাটা জমা দিতে হয়, বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতি নাটোর জেলা শাখার সাবেক সভাপতি ও অনিমা জুয়েলার্স এর স্বত্বাধিকারী নীরেন্দ্রনাথ কর্মকার দুলালের কাছে। আমি ছাড়া দ্বিতীয় তলায় সিঁড়ির পূর্ব পাশে আরো তিনটি দোকান ঘর রয়েছে। যাদের ভাড়া ৮ হাজার টাকা করেই।’’
সিঁড়ি ঘরের পূর্ব পাশের তৃতীয় তলায় স্বর্ণ ও চাঁদি গালানোর একটি কারখানা। কথা হয় কারখানা মালিক প্রবীণ ঘোষ এর সাথে, তিনি বারনইকে জানান, “এই দোকান ঘরের মালিক বিনয়। প্রতিমাসে ভাড়া বাবদ দিতে হয় ৫ হাজার টাকা। সিঁড়ি ঘরের পূর্ব পাশের তৃতীয় তলায় মোট ৪টি দোকান। প্রতিটা দোকানেই ৫ হাজার টাকা করে ভাড়া দিতে হয়।’’
এছাড়া দ্বিতীয় তলার পশ্চিম পাশে ৩টি শোরুম বন্ধ দেখা যায় এবং তৃতীয় তালার তিনটি কক্ষ বন্ধ পাওয়া যায়। এই ৬টি দোকানের মালিক অনিমা জুয়েলার্স এর সত্ত¡াধিকারী নীরেন্দ্রনাথ কর্মকার দুলাল বারনইকে বলেন, “পার্টনারশিপে হলমার্কের একটি শোরুম করার জন্য দোকান ঘর গুলো রাখা হয়েছে। বর্তমান দেশের অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে পরিকল্পনাটা স্থগিত করা হয়েছে। যদি কোন পার্টনার না পাই তবে নিজেই করব। আর মার্কেটের দ্বিতীয় তলার সিঁড়ি ঘরের পশ্চিমে যে দোকান ঘর রয়েছে সেটার মালিক সাবেক মেয়র উমা চৌধুরী জলির মেয়ে। দোকানের ভাড়া আমার কাছে থেকেই তিনি নিয়ে যান।” তবে তার সঠিক ঠিকানা তিনি বলতে পারেন নি।
শুধুমাত্র নীচতলা থেকেই ভাঙা উত্তোলন হয় ১ লক্ষ ৩০ হাজার টাকা। এছাঙায় দ্বিতীয় তলার ৪টি দোকান ঘর থেকে ভাঙা উত্তোলন হয় প্রতিমাসে ৩২ হাজার টাকা। তৃতীয় তলার ৪টি দোকান ঘর থেকে ভাঙা উত্তোলন হয় প্রতিমাসে ২০ হাজার টাকা। ৬টি রুম বন্ধ থাকা সত্তে¡ও পুরো মার্কেট থেকে বর্তমানে প্রতি মাসে ভাঙা উত্তোলন হয় ১ লক্ষ ৮২ হাজার টাকা। আর পৌরসভার রাজস্ব আয় প্রতি মাসে ৩৭ হাজার ৪ শত টাকা।